‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি শৈশব থেকেই আমার দুর্বলতা। মেডিকেলের অ্যাপ্রন আর স্টেথিস্কোপ ছিল আমার স্বপ্ন। তাই শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার স্বামী আমাকে ভর্তি করাল বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজে। আমার স্বামী আর বাবা এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। অথচ ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে স্বামী আমার সঙ্গে করল চরম অন্যায়-অবিচার। আমাকে জন্ম দিয়েই মারা গেছেন মা; আর মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আমাকে উপহার দিয়েছেন অত্যাচারী সৎ মা। সেই বাবাও আজ পরপারে। এত বড় পৃথিবীতে আপন আজ শুধু আমার সন্তান।’ কথাগুলো এক অসহায় স্ত্রীর, যিনি পেশায় চিকিৎসক।
পাঠক, আজ আমরা শুনব ভাগ্যবিড়ম্বিত মেয়েটির (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কণ্ঠে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা।
ওই চিকিৎসক নারীমঞ্চকে বলেন, ‘অভাবের সংসারে আমি ছিলাম সৎ মায়ের বোঝা। তাই এইচএসসির ফলাফল বের হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিল। ফলাফল ভালো দেখে আমার স্বামী সিদ্ধান্ত নিল আমাকে পড়ানোর। কিন্তু বিয়ের প্রথম বছরই হয়ে গেলাম মা। সংসারের কাজের চাপে ঠিকমতো হলো না প্রস্তুতি। সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ হারাতে হলো। শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে স্মায়ুযুদ্ধ করে স্বামী আমাকে ভর্তি করাল বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। আমাদের দাম্পত্য সুখ সৎ মা আর শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য হয়েছিল চরম যন্ত্রণার বিষয়। তারা নানা রকম বিশ্রী পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আমাদের দাম্পত্য কলহ বাধানোর জন্য। কিন্তু আমাদের পরস্পরের বিশ্বাসের কাছে পরাজিত হতো তারা। তারা চাইত না আমার নামের আগে যুক্ত হোক ‘ডা·’ নামের শব্দটি। যৌথ পরিবার থেকে আমার স্বামী অজস্রবার চেয়েছিল আলাদা হতে। কিন্তু আমিই তা হতে দিইনি। সবাই মিলেমিশে থাকার মধ্যেই প্রকৃত সুখ। কিন্তু সে সুখ আর রইল না আমার ভাগ্যে। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমার স্বামী উন্নত ভবিষ্যতের আশায় চলে গেল ইউরোপ। তার নিয়মিত যোগাযোগে মনে হতো না সে হাজার-লাখ মাইল দূরে। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল, বদলাতে থাকল তার আচরণ। আমার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করত সৎ মা আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে। একপর্যায়ে কমতে থাকল প্রতি মাসে পাঠানো টাকার পরিমাণ। একসময় সেটিও বন্ধ করে দিল। বাচ্চা আর আমার খরচ চালানোই দায় হয়ে উঠল তখন। টাকা পাঠাতে শুরু করল আমার সৎ মাকে। শত চেষ্টা করেও পেতাম না কোনো উত্তর। মোবাইল ফোনে অজস্র মেসেজ পাঠিয়েও হতো না কোনো কাজ। আমার জীবন এমন নাটকীয়তায় ভরে যাবে, এ আমি কোনো দিন ভাবিনি!
ভাশুরদের চক্রান্তে আমি বাসা ছাড়তে বাধ্য হলাম। আমার বাবার ঘরেও হলো না ঠাঁই। পৈতৃক সম্পত্তি জালিয়াতি করে অনেক আগেই নিয়েছিল সৎ মা। তখনো চিকিৎসক হইনি। অভাব আর মানসিক যন্ত্রণা আমার গলা চেপে ধরল। কষ্টের সাগরে দিশেহারা হয়ে পড়লাম আমি। আশার আলো হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার স্কুলজীবনের এক শিক্ষিকা। তাঁর বাসা সাবলেট নিয়ে রইলাম আমি। কমবয়সী মেয়ে হওয়ার দোষে কোথাও বাড়ি ভাড়া পেলাম না। আর ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্যও আমার ছিল না। সাবলেট থাকলেও আপা ভাড়া নিতেন না। বিভিন্ন সময় অর্থ ও মানসিক সাহায্য দিয়ে আমার জীবনে তিনি আজ বটবৃক্ষের মতো। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। প্রথম দিকে কাজের বুয়া রাখার সামর্থ্যও ছিল না। আমার বাচ্চাকে তিনিই দেখে রাখতেন।
এভাবে মানসিক টানাহেঁচড়ায় অর্জন করলাম এমবিবিএস ডিগ্রি। ফলাফল হাতে পেয়েই স্বামীকে মেসেজ পাঠালাম। দীর্ঘ কয়েক মাস পর পেলাম মেসেজের উত্তর। তাতে লেখা, “তুমি আমার কাছে মৃত। আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করবা না।” দুই লাইনের এই মেসেজে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। কিছুদিন আগে ছিল আমাদের বিবাহবার্ষিকী। বিবাহবার্ষিকীতে পার্থর (ছদ্মনাম) পাঠানো পার্সেলে ছিল মাঝারি আকৃতির একটি ফ্রেম। তাতে বাঁধাই করা স্বামী-স্ত্রীর ছবি। ছবির পেছনে বড় করে লেখা-মি· অ্যান্ড মিসেস পার্থ। ছবি দেখে মনে হলো পার্থর চেয়ে বয়সে অনেক বড় বিদেশিএক মহিলা। পৃথিবীর কোনো স্বামী যেন তার স্ত্রীকে বিবাহবার্ষিকীতে এমন উপহার না দেয়। অনেকবার মনে করি পার্থকে ভুলে যাব। কিন্তু বাচ্চাটার জন্যই প্রতিমুহূর্তে অনুভব করি তার বাবার শূন্যতা।
পার্থ আমার কথা না-ই বা ভাবল, সন্তানটার কথা ভাবতে পারত! টাকার জন্য আমি দুটো হাসপাতালে চাকরি করি। মাঝেমধ্যে থাকে নাইট ডিউটি। আমার কষ্টকে নিজের হিসেবে উপলব্ধি করেন এই আপা। পার্থ, তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ প্রতিবেদন তোমার চোখে পড়বেই। তুমি আমাকে যে কষ্ট দিয়েছ। তার কোনো ক্ষমা নেই। তোমার বিরুদ্ধে আইন-আদালতে যেতে আমার ঘৃণা হয়। জেনে রেখো, তোমার স্ত্রী ছিল সম্পূর্ণ নিরপরাধ। পার্থ, শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।
ভুক্তভোগী এই নারী চান না তাঁর মতো হোক কোনো মেয়ের জীবন। নারীমঞ্চের মাধ্যমে তিনি সব নারীর উদ্দেশে বলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে···।’
ফারহানা মোবিন
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০০৯
Leave a Reply