সেই হবুচন্দ্র রাজা থেকে শুরু করে রূপকথার সিন্ডারেলা, কিংবা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে এ যুগের ফার্স্টলেডি ইমেলদা মার্কোসের সহস্রাধিক জোড়া জুতার মালিক বনে যাওয়া; পায়ের সঙ্গী জুতা নিয়ে এমনি কত গল্পই তো ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। অন্যদিকে গল্পের রঙ্গিন জগত থেকে বাস্তবতার পথে পথে জুতা না হলে যে আমাদের একদিনও চলবার নয় সে তো চূড়ান্ত এক সত্য। তাই পথ চলার প্রয়োজনেই হোক কিংবা চলার পথের সঙ্গী জুতার ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ই হোক জুতা নিয়ে কমবেশি ভাবতে হয় সকলকেই। বিশেষ করে ফ্যাশনে যারা কেতাদুরস্থ, মাথা থেকে পা অবদি আপাদমস্তকই যাদের ফ্যাশন রাজ্যের রাজত্ব জুতা নিয়ে তাদের চিন্তাটাও নেহাত কম নয়। কাজেই ‘পরতে হবে বলে পরলাম’ এর চাইতে ‘এ যুগে সবাই এমনটা পরে বলেই পরছি’ এই বাক্যগুলোই জুতা কেনার যুৎসই কারণ। আর স্টাইল দুনিয়ার মানুষের এই ভাবনার বিবর্তনই জুতাকে করে তুলেছে পায়ের আভরণ।
কেমন জুতা পরছে এ সময়ের তরুণ-তরুণীরা? কিংবা বয়সের ঘরে একটু উপরের দিকে বাস করেও যারা ভুলতে চাইছেন না স্টাইলের ভাবনাটিকে তারাই বা কেমনতর জুতার দিকে ঝুঁকছেন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে ফ্যাশনের অন্য সব ধারার মতো জুতার ফ্যাশনেও ছেলে-মেয়ের প্রভেদটা বড় হয়ে দেখা দিতে বাধ্য। আর ফ্যাশনের ভাবনাটা যখন দেশের গন্ডিতে তখন একথা অনেকটা নির্দ্বিধায়ই বলা চলে যে, জুতার ফ্যাশনে মেয়েরা এখন একটু ছোট হয়ে গেলেও ছেলেরা আছে আগের জায়গাতেই। আপাতদৃষ্টিতে এ বিষয়টিকে হেয়ালী বলে মনে হলেও, মেয়েদের মাঝে যখন অব্যাহতভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে ফ্ল্যাট স্যান্ডেল আর ছেলেদের মাঝে চলে আসছে সেই স্নিকারস্ এর চল, তখন এ কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়!
ফ্যাশনের যেকোনো আলোচনার মতো জুতার আলোচনাতেও মেয়েদের প্রতি একটু পক্ষপাত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ স্টাইল আর ফ্যাশনের যেকোনো অনুষঙ্গ নিয়ে মেয়েদের ভাবনাটা যত বেশি ছেলেরা এখনো সেখানে খানিকটা পিছিয়েই। আর হাল আমলে মেয়েদের পায়ের আভরণ হিসেবে ফ্ল্যাট স্যান্ডেলেরই জয়-জয়কার। ক্যাজুয়াল কোনো পার্টিই হোক কিংবা অফিস থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের চৌহদ্দি, সবখানেই নানা ধারার ফ্ল্যাট স্যান্ডেল একের পর এক পরাস্ত করে চলছে হিল টাইপের জুতোকে। আর জুতার ফ্যাশনে ফ্ল্যাট এর এই কদরের কারণেই বাজার ঘুরে দেখা মিলবে বহু ধরনের ফ্ল্যাট জুতার। এইসব ফ্ল্যাট স্যান্ডেলের মধ্যে দু’ফিতার িপার যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে খানিকটা চটি টাইপের শক্ত সোল-এর জুতাগুলোও। মেয়েদের মধ্যে যারা পড়াশোনা কিংবা অন্যকোনো ব্যস্ততার কারণে হরহামেশাই ছুটোছুটি করছেন ঘরে-বাইরে; আরাম আর স্টাইলের যুগলবন্দীর কারণে দু’ফিতার
স্লিপারগুলোই তাদের বেশি পছন্দ। অন্যদিকে যারা একটু কর্পোরেট পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন তাদের জুতার হিলও এখন এক থেকে দেড় ইঞ্চির কোটা ছাড়াচ্ছে না। দু’ফিতার ফ্ল্রাট স্যান্ডেলে একটা ক্যাজুয়াল লুক থাকে বলে হাল ফ্যাশনের দু’ফিতার িপারে তেমন একটা কারুকাজ থাকে না। বরং চামড়া কিংবা রেক্সিনের বুননের পার্থক্য আর ফিতার রকমফেরই এ জাতীয় িপারের স্টাইলের মূলমন্ত্র। অন্যদিকে একটু হিল টাইপ যে জুতাগুলো এখন ফ্যাশন ট্রেন্ড এর সাথে খাপ খাইয়ে চলছে সেগুলোতে দেখা মিলছে নানা রকমারী পাথরের কাজ। মাল্টি স্টোনের কারুকাজ সম্বলিত এই হিলগুলো বিভিন্ন ধরনের পোশাকের সাথে সহজেই মানিয়ে যায় বলে অফিসগামী তরুণী কিংবা পার্টি’র সাজে সাজা কন্যাদের বিশেষ পছন্দ হয়ে উঠেছে এ ধারার জুতা। অন্যদিকে ফ্ল্যাট ট্রেন্ডের এই সময়েও যারা তাদের পায়ে পায়ে বাঁচিয়ে রাখতে চান হাই-হিলের ট্রেন্ডকে তারা সাধারণত চিকন রঙ্গীন ফিতার কালারফুল পেন্সিল হিলগুলোর প্রতিই মনোযোগ নিবিষ্ট রাখছেন।
ফ্ল্যাট স্যান্ডেলের ভুবনে বর্তমান সময়ের আরেক জনপ্রিয় ট্রেন্ডের নাম চটি। দুই ফিতার স্যান্ডেলের সাথে চটি টাইপের জুতার মূল পার্থক্য আসলে এর সোল-এ। যেখানে দু’ফিতার ফ্ল্যাট স্যান্ডেল এর সোলটি আরাম এর কথা চিন্তা করে একটু নরমই রাখা হয় সেখানে চটি অনেকটাই শক্ত একহারা সোল-এ তৈরি। আর এই সোল এর উপর দেশীয় নানা উপকরণ যেমন কাঠ, পুঁতি, পাথর বা চুমকির সুনিপুণ ব্যবহারই অনন্য করে তুলেছে চটিকে। এছাড়া িপার স্যান্ডেলের দেশীয় ট্রেন্ডে ইদানিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বর্ণিল লেস, জরি কিংবা এম্ব্রয়ডারির নকশাও। এদিকে বয়সের দিক দিয়ে যারা তরুণীদের চাইতেও কমবয়সী অর্থাৎ কেতাবী ভাষায় যারা এখনো টিনএজ তাদের কাছে দেশীয় ফ্যাশনের িপারের চাইতে একটু ওয়েস্টার্ন ঘরানার গ্ল্যাডিয়েটর স্যান্ডেলই বেশি পছন্দের। আর সাধারণ ফ্ল্যাট স্যান্ডেলের সাথে গ্ল্যাডিয়েটর স্যান্ডেলের প্রধান পার্থক্যের জায়গা হলো এতে পায়ের গোড়ালি থেকে উপরের বেশ খানিকটা অংশ অবদি থাকে বাঁধার মতো স্টাইলিশ ফিতা।
আমাদের দেশের অভিজাত প্রায় সবগুলো শপিং মলেই দেখা মেলে বেশ কিছু স্টাইলিশ জুতার দোকানের। তবে জুতা কেনার জন্য আলাদাভাবে যে জায়গাগুলো এই নগরীতে বেশ প্রসিদ্ধ তার মধ্যে রয়েছে এলিফ্যান্ট রোড ইস্টার্ন প্লাজা, ধানমন্ডির রাপা প্লাজা, র্যাংগস আনাম প্লাজা, মেট্রো শপিং মল, রাইফেলস্ স্কয়ার, বসুন্ধরা সিটি, গুলশানের পিংক সিটি, উত্তরার নর্থ টাওয়ার, আড়ং ও আলমাস এর আউটলেট প্রভৃতি। এছাড়া যারা রাফ ইউজের জন্য বিভিন্ন জুতার খোঁজে আছেন তারা ঢুঁ মারতে পারেন নিউমার্কেট ও গাউসিয়ার সামনে গড়ে ওঠা জুতার দোকানগুলোতে।
জুতো কেনার টিপস্
০ বেল্টের জুতা হলে বকলেস ঠিক আছে কিনা, জিপার ঠিকমতো ছোটবড় করা যায় কিনা কিংবা প্রয়োজনের চাইতে এটি ছোট কিনা সেটি ভাল করে দেখে কিনুন।
০ জুতার ফিতার সংযোগস্থল টেকসই কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
০ স্যান্ডেলে যদি পুঁতি কিংবা জরির মতো কোনো উপকরণের কাজ থাকে তাহলে এগুলো দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা কিংবা এই জুতা পায়ে দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানো যাবে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখুন।
০ জুতার মাপ আপনার পায়ের সাথে মানানসই কিনা সেটি বোঝার জন্য সম্ভব হলে দোকানের মাঝেই কয়েক কদম হেঁটে দেখুন। এছাড়া জুতাটি আপনার পায়ে মানাচ্ছে কিনা সেটি আয়নায় দেখে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
০ যারা উঁচু হিলের জুতা পরেন তারা হিল নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা উঁচু হিল স্বাচ্ছন্দ্যে পরা যায় সেদিকে খেয়াল রাখুন। কেননা হিল মানানসই না হলে কোমর বা পিঠে ব্যথা হতে পারে।
০ বর্ষার দিনে স্লিপার জুতা কোনো সমস্যা তৈরি করবে কিনা অথবা পানি লাগলে এর স্থায়িত্ব কমে যাবে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলোও জুতা কেনার সময়ই ভাবুন।
জুতার যত্ন
০বাইরে থেকে ফেরার পর অবশ্যই শুকনো কাপড় দিয়ে জুতা ভাল করে মুছে রাখবেন
০ যাদের পা বেশি ঘামায় তারা সম্ভব হলে ঘাম মুছে জুতা পায়ে দেবেন
০ ভেজা কাপড় দিয়ে কখনোই জুতা মুছবেন না। এতে জুতার ঔজ্জ্বল্য কমে যায়
০ পাথর, পুঁতি, লেস, জরি কিংবা এম্ব্রয়ডারির কাজ করা জুতার ডিজাইনের মাঝে যেন ধুলা জমে না থাকে সেজন্য শুকনো ব্রাশ দিয়ে এ অংশগুলো পরিস্কার করুন।
০ খোলা জায়গায় জুতা ফেলে রাখবেন না। সম্ভব হলে একটি র্যাকে জুতা রাখুন কিংবা অন্যকোনো স্থানে জুতা রাখলে তার উপর যেন ধূলা জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
০ বিকল্প থাকলে একই জুতা দিনের পর দিন পরবেন না।
স্টাইলিশ এই জুতোগুলো পাওয়া যাবে মান্ত্রা’য়। ঠিকানা : মান্ত্রা এক্সক্লুসিভ ফ্যাশন স্টোর, সিইএস(জি)১, রোড ১৩০, গুলশান ১, ঢাকা, ফোন : ৮৮১৪১৪০, ৮৮৫৩০১২, ০১১৯৯১৫৮৭৯৪।
মডেল রুহি ও মিম ছবি ইকবাল আহমেদ
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ১৮, ২০০৯
Leave a Reply