প্রস্রাব করার সময় কষ্ট বা ব্যথা অনুভূত হওয়াকে চিকিৎসা পরিভাষায় ডিসইউরিয়া বলে। পুরুষ ও মহিলা উভয়েই এ সমস্যায় ভুগতে পারেন। অল্পবয়স্ক পুরুষদের তুলনায় অধিকবয়সী পুরুষরা এ সমস্যায় বেশি ভোগেন। দেখা গেছে, একবার কেউ আক্রান্ত হলে আবার আক্রান্ত হতে পারেন।
সারাজীবনে যে কেউ বারবার আক্রান্ত হতে পারেন। এটা মূত্রপথে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের কারণে, অথবা যৌনবাহিত রোগের কারণে হতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটাকে রোগ হিসেবে চিকিৎসা করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে এটা অন্য কিছু রোগের উপসর্গ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রের উৎপত্তি যৌনগত। এ কারণে ডিসইউরিয়ার রোগীর একক কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। উপসর্গ ও কারণের ওপর ভিত্তি করে এর চিকিৎসা করা হয়।
ডিসইউরিয়ার ধরন
ডিসইউরিয়া কোনো রোগ নয়, তবে এটা কিছু রোগের একটি উপসর্গ। নিম্নলিখিত কারণে পুরুষের ডিসইউরিয়া বা প্রস্রাব করার সময় ব্যথা হতে পারেঃ
প্রোস্টেটাইটিস
এটা হচ্ছে প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রদাহ। এ অবস্থায় প্রোস্টেট গ্রন্থি ফুলে গিয়ে মূত্রথলিতে চাপ দেয়। প্রোস্টেটাইটিসের ক্ষেত্রে প্রস্রাব করার সময় পুরুষাঙ্গের গোড়ায় ব্যথা অনুভূত হয়। প্রস্রাব করার পরে ব্যথা ক্রমে বাড়তে থাকে।
ইউরেথ্রাইটিস
ইউরেথ্রাইটিস হলো মূত্রনালীর প্রদাহ। এ ক্ষেত্রে মূত্রনালীর মুখে অর্থাৎ লিঙ্গমণ্ডুর ছিদ্রে ব্যথা অনুভূত হয়।
এই ব্যথা প্রস্রাব করার সাথে সাথেই অনুভূত হয়। সাধারণত প্রস্রাব করা শেষ হয়ে গেলে ব্যথা চলে যায়।
এপিডিডাইমাইটিস
এটা হলো এপিডিডাইমিসের প্রদাহ। এপিডিডাইমিস একটি নালী যেখানে অণ্ডকোষের শুক্রাণু জমা থাকে।
ক্লামাইডিয়া
ক্লামাইডিয়া হলো ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ যার কারণে মূত্রনালীতে প্রদাহ হয় এবং এর ফলে ব্যথাযুক্ত প্রস্রাব হয়।
গনোরিয়া
ক্লামাইডিয়ার মতো গনোরিয়াও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ এবং এ ক্ষেত্রেও একই রকমের উপসর্গ দেখা দেয়। মূত্রনালীতে প্রদাহের কারণে ব্যথা হয়।
সিস্টাইটিস
সিস্টাইটিস হলো মূত্রথলির প্রদাহ। মূত্রনালীর ছিদ্রের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া মূত্রথলিতে ঢুকলে সিস্টাইটিস হয়। এ ক্ষেত্রে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, প্রস্রাব করার সময় ব্যথা করে।
পাইলো নেফ্রাইটিস
পাইলো নেফ্রাইটিস হলো কিডনির প্রদাহ। এ ক্ষেত্রে বারবার প্রস্রাব করার ইচ্ছে জাগে। প্রস্রাব দুর্গন্ধযুক্ত হয় এবং মূত্রনালীতে জ্বালাপোড়া করে।
ডিসইউরিয়ার কারণ
ডিসইউরিয়ার কারণ অনেক। প্রদাহের কারণে অথবা যৌন বাহিত রোগের কারণে ডিসইউরিয়া হতে পারে। উপরের কারণগুলো ছাড়াও আরো কিছু কারণে ডিসইউরিয়া বা প্রস্রাব করার সময় ব্যথা হতে পারে, যেমন-
মূত্রথলিতে অথবা মূত্রনালীতে ক্যান্সার
মূত্রপথে প্রতিবন্ধকতা
কিডনিতে অথবা মূত্রথলিতে পাথর
শারীরিক পরিশ্রম যার কারণে মূত্রথলি বা মূত্রনালীতে চাপ পড়ে, উদাহরণ স্বরূপ সাইকেল চালানো কিংবা ঘোড়ায় চড়া
সজোরে যৌনমিলন, যার কারণে মূত্রনালীতে আঘাত লাগতে পারে।
ডিসইউরিয়ার উপসর্গ
প্রস্রাব করার শুরুতে কষ্ট হয়। দু’নালে হয় অথবা প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব পড়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধীরগতিতে প্রস্রাব হয়।
প্রস্রাব করার সময় ব্যথা শুরু হয়। ডিসইউরিয়ার কারণের ওপর নির্ভর করে ব্যথা মূত্রনালীর মাথায়, অথবা প্রোস্টেটে অথবা মূত্রনালীতে অনুভূত হতে পারে।
প্রস্রাব করার সময় সর্বদা জ্বালাপোড়া করে।
ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, তবে প্রতিবারের প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিক ব্যক্তির প্রস্রাবের চেয়ে কম হয়।
প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয় এবং প্রস্রাবে দুর্গন্ধ থাকে।
প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে।
যৌন মিলনের সময় ব্যথা করে।
কারা ডিসইউরিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
যে কারো যেকোনো সময় ডিসইউরিয়া হতে পারে। তবে অন্যদের চেয়ে যেসব লোকের বেশি ঝুঁকি রয়েছেঃ
পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
বয়সী পুরুষরা (৬০ বছরের বেশি) বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বয়স্ক পুরুষদের ডিসইউরিয়া হয় মূত্রপথে প্রদাহের কারণে, এর মধ্যে মুত্রথলি এবং কিডনিও রয়েছে।
যৌনভাবে সক্রিয় অল্পবয়স্কদের ডিসইউরিয়া খুব সাধারণ। যারা অরক্ষিত যৌন চর্চা করেন তাদের ডিসইউরিয়া বেশি হয়।
অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের ডিসইউরিয়া বেশি হয়।
ডিসইউরিয়া প্রতিরোধ
সবসময় ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে।
যেসব পুরুষের খৎনা করানো হয়নি, তাদের খৎনা করতে হবে। প্রস্রাব করার পর লিঙ্গমণ্ডু ভালো করে ধৌত করতে হবে।
গোসল করার সময় মৃদু সাবান (যে সাবান ত্বকে অ্যালার্জির সৃষ্টি করে না) দিয়ে যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করতে হবে।
নিরাপদ যৌন মিলনের অভ্যাস করতে হবে।
যৌন মিলনের সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে যৌনাঙ্গে আঘাত না লাগে। যদি যৌন সঙ্গিনীর পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সন্দেহ থাকে তাহলে অবশ্যই প্রোটেকশন ব্যবহার করতে হবে।
ধূমপান পরিহার করতে হবে।
ডিসইউরিয়ার লোকদের জন্য খাবার
ডিসইউরিয়ার ক্ষেত্রে খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচের পরামর্শগুলো অবশ্যই মেনে চলবেন-
দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় পানিকে অবশ্যই প্রাথমিক প্রাধান্য দিতে হবে। দিনে কমপক্ষে আট থেকে দশ গ্লাস পানি পান করবেন। তবে ঘুমোতে যাওয়ার সময় পানি পান করবেন না।
তেল ও মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করবেন। এসব খাবার একটুও তালিকায় রাখবেন না।
কিছু খাবার ডিসইউরিয়া কমাতে পারে
গম ও বার্লি
এলাচি
মাংসের স্যুপ
ডিসইউরিয়ায় যেসব খাবার নিষেধ
হিং
অতিরিক্ত আদা ও লবণ
অতিরিক্ত গরম, মসলা ও তেলযুক্ত খাবার
মরিচ
অ্যালকোহল
মনে রাখবেন ডিসইউরিয়ার ঠিকমতো চিকিৎসা না করালে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রস্রাবে ব্যথা অনুভূত হওয়া মাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। যত দ্রুত চিকিৎসা নেবেন ততই মঙ্গল।
————————
ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
চেম্বারঃ কমপ্যাথ লিমিটেড, ১৩৬ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা (সোম, মঙ্গল ও বুধবার)। যুবক মেডিক্যাল সার্ভিসেস, বাড়িঃ ১৬, রোডঃ ২৮ (পুরান), ১৫ (নতুন), ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ঢাকা (শনি, রবি ও বৃহস্পতিবার)।
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১ জুন ২০০৮
Leave a Reply