‘.. .. এইসব আমি তোকেই দেবো, তোকে দেবো, তোর ছেলেবেলা তোর কাছ থেকে চেয়ে নেবো.. ..’ বাল্য বিবাহের কথা আসলেই মৌসুমী ভৌমিকের গানের এই লাইনটি খুব মনে পড়ে। বাল্য বিবাহ কীভাবে নারীর শৈশব-কৈশোর আর স্বপ্নময়তার দিনগুলোকে কেড়ে নেয়, কী অমানবিক মাপজোক করে ঠিক করে দেয় তার চোখের দৃষ্টিসীমানা, গভীর কালো এক পর্দা টেনে দেয় মনের আকাশটাতে, আর সব মিলিয়ে বিষয়টিকে যখন সামগ্রিক রাষ্ট্র আর সামাজিকতার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা হয়, তখন বিষয়টি দাঁড়ায় এক জাতীয় সমস্যা হয়ে, যার প্রতিকারে প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ। যতোই সময় যাচ্ছে, বাঙলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাল্যবিবাহ অত্যন্ত ভয়াবহ একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সমস্যার নখর এখন এতোটাই খামছে ধরেছে যে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, বাঙলাদেশে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের কারণে যে কয়টি ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাল্য বিবাহ। বাল্য বিবাহের পরিণতিতে শুধু শিশু, অল্পবয়সী নারী বা তার পরিবারই আক্রান্ত হয় না, এতে দেশ হয় অপুষ্টি ও দুর্বল ভবিষ্যত প্রজন্মের উত্তরাধিকারী। দেশের উন্নয়নের জন্য যেখানে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেখানে বাল্য বিয়ে ও এর পরিণতি সংক্রান্ত বিষয়ে নিস্পৃহ দৃষ্টিভঙ্গি কোনো সচেতন নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। এ বিষয়টিকেই ভাবনার প্রেক্ষণবিন্দুতে রেখে এবারের মূল ফিচারটি যৌথভাবে তৈরি করেছেন মেরীনা চৌধুরী ও গোলাম রসূল মারুফ।
একটি দৃশ্যপট, অতঃপর.. ..
মিঠাপুকুর উপজেলার রহম আলীর ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড়ো শেফালী, তার বয়স ১০ বছর। এখনো বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেননি বলে গ্রামের মাতবর ডেকে দু মাসের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। এ নিয়ে রহম আলী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন উপায়ন্তর না দেখে ২৫ বছর বয়সী বিপত্মিক পাত্র নাছিরের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। নাছির যেহেতু গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্ত, তাই পাত্র হিসেবে তাকে বেছে নেয়ার আগে রহম আলী একবারও ভাবলো না বয়স কিংবা বিয়ের জন্য শেফালীর শারীরিকভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠা। মূলত সমাজও এক্ষেত্রে প্রভাবক হয়েছে, সমাজের নানাস্থানে এরকম বাল্যবিয়ের দৃশ্য চোখে পড়ে, কোনোটা উঠে আসে গণমাধ্যমের পাতায়, আবার কোনোটা হারিয়ে যায়, হাজারো কোলাহলে হারিয়ে যায় বালিকা বধূর কান্না, কখনো বা মৃত্যুর আগের শেষ আর্ত-চিৎকারটিও।
বাল্যবিবাহের ইতিহাস
সেই কবে কোন যুগে বাল্য বিবাহের শুরু হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাস না পাওয়া গেলেও আদি যুগের গোত্র ও পরবর্তীকালে নানাবিধ প্রথা নিঃসৃত ধারণা এ বাল্যবিয়ের ধারণা দেয় এবং এর বিস্তৃতি ঘটে সমাজ-সংসারে। ষোড়শ শতকের অষ্টম দশকেও সমগ্র উপমহাদেশে বাল্য বিবাহের প্রচলন ছিলো বলে ইউরোপীয় পরিব্রাজকদের বর্ণনায় প্রকাশ পায়। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে তৎকালীন সমাজের বাল্য বিবাহ প্রথার প্রমাণ পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে স্ক্রাফটনের মন্তব্য, “এই উপমহাদেশের ছেলেমেয়েদের শিশুকালে বিয়ে দেয়া হতো। ১২ বছর বয়সে একজন রমনীর কোলে একটি সন্তান- এটা ছিলো সাধারণ দৃশ্য”। সে যুগে ৬-৭ বছর বয়সের পর অবিবাহিত নারী ঘরে থাকা মানেই অসম্মানজনক একটি বিষয়। অবিবাহিত নারীর বাবা-মা সমাজের সকলের চোখে ছিলো নিন্দনীয়। এমনকি সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবেও সেই পরিবারের সঙ্গে সমাজ সম্পর্ক ছেদ করে সম্পূর্ণভাবে তাকে একঘরে করে রাখা হতো, সামাজিকভাবে যা ছিলো অত্যন্ত কঠোর ও অপমানজনক। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে তৎকালীন প্রাজ্ঞ ও বোদ্ধাজনেরা বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্র সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একটি গতিশীল সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেন। কিন্তু প্রায় এক শতাব্দীকাল অতিক্রম হলেও আমরা আজো বাল্য বিবাহের বদ্ধ শিকল থেকে কতোটুকু মুক্ত হতে পেরেছি?
বাল্যবিবাহ: বাঙলাদেশ প্রেক্ষিত
বেসরকারি সংস্থা ম্যাস লাইন মিডিয়ার এক জরিপে ২০০৭ সালের হিসেবে জানা যায়, সারা দেশে মোট ২০৩টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১১২ জন শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো এর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে মাত্র ৭টি এবং এ ৭টি বাল্য বিবাহই বন্ধ করা হয়েছে। পরের চিত্রগুলো আরো হতাশাব্যঞ্জক। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ওয়ার্ল্ড চিলড্রেনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাঙলাদেশের ৬৪ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর হবার আগেই, অন্যদিকে ১৫ থেকে ১৯ বছরেই অন্তঃসত্ত্বা কিংবা মা হয় এক-তৃতীয়াংশ। অন্যদিকে বাঙলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী পরিষদের এক রিপোর্টে জানা যায়, সারা দেশে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ কিশোর-কিশোরী রয়েছে, যার শতকরা ১৩ দশমিক ৭ ভাগ মেয়েশিশু। এর মধ্যে ৪৭ ভাগ মেয়ে শিশুর বিয়ে ১৯ বছরের আগেই হয়ে যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০ বছর বা তদূর্ধ্বো নারীদের তুলনায় ১৮ বছরের নিচের প্রসূতিদের মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় ২-৫ গুণ বেশি। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে বাল্য বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ হিসেবে দারিদ্র্যতাকেই চিহ্নিত করেছেন সমাজবিজ্ঞানী ও আইনজ্ঞগণ। তাঁরা মনে করেন, দারিদ্র্যতা যেহেতু মানুষের সকল মৌলিক চাহিদাগুলোকে কারারুদ্ধ করে ফেলে, সেহেতু মানুষ তখন প্রয়োজনের কাছে সকল আইনকে জলাঞ্জলি দেয়। তাছাড়া শিক্ষার অভাবও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাঙলাদেশের এমন অনেক স্থান আছে যেখানে এখনো শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। এতেও বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বাল্য বিবাহের দৃশ্য সবচেয়ে ভয়াবহভাবে ধরা পড়ে উত্তরাঞ্চলের রংপুর জেলায়। এখনো সেখানে পাঁচ বছরের বালিকাদের সঙ্গে সত্তর বছরের বৃদ্ধের বিয়ের ঘটনা ঘটে। অথচ এ রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামেই জন্ম নিয়েছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া। যদিও বাঙলাদেশের সরকার বিয়ের ক্ষেত্রে নারীদের বয়স ১৮ বছর এবং পুরুষের বয়স ২১ বছর ঠিক করে দিয়েছে- তবুও এখানে নানা কারণে প্রতিনিয়ত বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছে নারীরা।
বাল্যবিবাহ রোধে আইন
১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ বলতে বোঝায়, বাল্যকাল বা নাবালক বয়সে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে। এছাড়া বর-কণে উভয়েরই বা একজনের বয়স বিয়ের দ্বারা নির্ধারিত বয়সের চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হলে তা আইনত বাল্যবিবাহ বলে চিহ্নিত হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় অধিকাংশ স্থানেই বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের কোনো যথাযথ প্রয়োগ নেই। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে তিন ধরণের বিয়ে অপরাধ বলে ধরা হয়েছে; এক, প্রাপ্ত বয়স্কের সঙ্গে অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিবাহ; দুই, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে; তিন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাত্র-পাত্রীর অভিবাবক কর্তৃক বিবাহ নির্ধারণ বা বিয়েতে সম্মতি দান। এ আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের বয়স ২১ এবং মেয়ের বয়স ১৮ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ আইন অমান্য করলে একমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় বিধানই হতে পারে।
অন্যান্য সমস্যা
বাঙলাদেশে জন্মহার হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে প্রধান দুটি অন্তরায় হলো বাল্যবিবাহ ও অল্প বয়সে সন্তান ধারণ। অল্প বয়সে সন্তান ধারণের ঘটনা এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশি ঘটে। বাল্যবিয়েতে প্রথম শিকার হয় শিশু, দ্বিতীয় শিকার নারী এবং তৃতীয় শিকার সমাজ। এর সুদূর প্রসারী ফল প্রকারান্তরে সমগ্র জাতির উপর গিয়ে পড়ে। বাল্যবিয়ে নিরোধে জন্মনিবন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বিয়ের সময় জন্ম সনদ প্রদর্শন অতি বাধ্যতামূলক আবশ্যক। বাল্য বিবাহে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে নিরাপদ মাতৃত্ব অন্যতম। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য সঠিক বয়সকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া নারীর সঠিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা এবং পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর সিধান্ত গ্রহণের অধিকার অর্জন, বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় প্রথা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে।
তবুও প্রত্যাশার বাতিঘর
বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে নারী নিজেই সচেতন হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায় বাবা-মা জোর করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস এক নারীকে নিষিদ্ধ সংগঠন শিবিরের কর্মীর সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইলে মেয়ে নিজেই তার প্রতিবাদ করে। সনদ অনুযায়ী তার বয়স ১৭ বছর এবং এ বক্তব্য উল্লেখ করে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির মাধ্যমে বাবা-মাকে উকিল নোটিশ পাঠায় সেই নারী। এ পদক্ষেপ সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়। নারী নিজেই যখন বাল্য বিবাহ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে, তখন নিশ্চিত নারী মুক্তি লাভ করবে এ ঘৃণ্য অভিশাপ থেকে। আর যখন পুরো সমাজ, রাষ্ট্র এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠবে, তখন বাল্য বিবাহের আড়ষ্টতা থেকে নারী বেরিয়ে আসবে- এ প্রত্যাশায় আমাদের সবাইকে একসঙ্গে বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করতে হবে।
মডেল: ঊষশী, অনন্যা, হিমু
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ১২, ২০০৯
রায়হান
আমাদের এখানে একটি বিয়ে হবে আগামি জুন এর 2 তারিক। মেয়ে টির বয়স 15 বছর। আপনারা কি কোনো ব্যবসতা নিতে পারবেন।
Bangla Lifestyle
এলাকার লোকজন সচেতন হলে, উনারা এগিয়ে এলে, মেয়ের বাবা-মাকে বুঝিয়ে এসব বন্ধ করা যায়।