রবিঠাকুরের ‘জুতা-আবিষ্কার’ কবিতার কাহিনীটি নিশ্চয়ই জানেন!
হবু রাজার রাজ্য ছিল ধূলিময়। মন্ত্রী গোবুকে সেই ধুলা তাড়াতে বললেন রাজা। পণ্ডিত, উজির, মন্ত্রী, নাজির-সবাই বসল সলাপরামর্শে। সিদ্ধান্ত হলো ঝাড়ু দিয়েই বিদায় করা হবে ধুলা। কেনা হলো সাড়ে ১৭ লাখ ঝাড়ু। ধুলায় ভরে গেল আকাশ-বাতাস। আবার বসল রাজবৈঠক। সিদ্ধান্তমতো নদী-নালা উজাড় করে ধুলায় ঢালা হলো পানি। কাদায় কাদায় রাজ্য একাকার। রাজার পদ ফেলা ভার। উজির-নাজির-মন্ত্রী মিলে সিদ্ধান্তে এল চামড়া দিয়ে মুড়ে দেওয়া হবে পুরো রাজ্য। খুঁজে আনা হলো চর্মকার। চর্মকার বলল-এত ঝামেলার গিয়ে কী লাভ; বরং রাজামশায়ের পদযুগল চর্মে ঢেকে যাক···হইহই রইরই···আবিষ্কৃত হলো পাদুকা! সেদিনের সে পাদুকার আজকের রূপ দেখলে হয়তো অবাক হতেন সেই রাজামশাই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাদুকা অর্থাৎ জুতা-স্যান্ডেলের ফ্যাশনে এসেছে বৈচিত্র্য। পাদুকার মধ্যে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গাটা দখল করেছে আকর্ষণীয় সব ফ্ল্যাট বা চটি জুতা। ‘ফ্যাশন আর আরাম-এ দুইয়ের এক সুষম সমন্বয় ঘটেছে ফ্লাট স্যান্ডেলে। তাই তো সবার পায়ে বেশ চমৎকারভাবেই মানিয়ে গেছে এ চটিগুলো।’ জানালেন আড়ংয়ের বিপণন নির্বাহী সাদিয়া হক।
ফ্যাশনে চটি
‘আমাদের দেশে চটির ফ্যাশনটা খুব নতুন নয়। আগে এটি নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুল-কলেজের মেয়েরা বেশি পরত চটি। শুরুর দিকে বলিউডের ছবিতে ফ্ল্যাট স্যান্ডেলের ব্যবহার দেখা গেছে। ওখান থেকেও আমাদের দেশের মেয়েরা এতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।’ বললেন সাদিয়া হক। পাশাপাশি ফ্যাশন ডিজাইনাররাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন চটির ডিজাইনে নতুনত্ব আনতে। আমাদের দেশে সম্প্রতি স্যান্ডেলের এ ধারাটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শুধু শিক্ষার্থী মেয়েরা নয়, কর্মজীবীসহ নানা বয়সী নারীর পায়েই জুড়েছে চটি। চটির সুবিধা হলো, এটি চটপট পরা যায়, চলাফেরায় আরামদায়ক।
পায়ে পায়ে চটি
অনেক নারীকেই প্রতিদিন ছুটে যেতে হয় কর্মস্থলে। কাজ নিয়ে ছুটোছুটি তো নৈমিত্তিক ব্যাপার কর্মজীবীদের জন্য। ঢাকার জাপানি দূতাবাসে চাকরিরত কাজী বুশরা আহমেদেরচলার সঙ্গী ফ্ল্যাট স্যান্ডেল। হাঁটাচলায় আরামদায়ক বলে জুতা হিসেবে ফ্লাট স্যান্ডেলই তাঁর বেশি পছন্দ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জিতুরও ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পছন্দ। কারণ, ক্যাম্পাসে ছোটাছুটি, ঘোরাঘুরির জন্য এটিই তাঁর কাছে আরামদায়ক মনে হয়। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত-সব স্থানেই পায়ের সঙ্গী এই চটি স্যান্ডেলগুলো। যেকোনো বয়সের জন্যই এটি মানানসই।চটি বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে-হিল পরলে গোড়ালি, হাঁটু ও কোমরের হাড়ে অনেক চাপ পড়ে (তা থেকে অনেক সময় ব্যথা অনুভূত হয়)। অন্যদিকে ফ্ল্যাট স্যান্ডেল অনেকটাই নিরাপদ।
বৈচিত্র্যের ছোঁয়া
এখনকার চটিগুলোয় নানা বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। প্রচলিত স্যান্ডেলের মধ্যে বেশি দেখা যায় দুই ফিতার স্যান্ডেল। এ ছাড়া সম্প্রতি অল্প বয়সী (টিনএজ) মেয়েদের মধ্যে বহু স্ট্র্যাপ দেওয়া ‘গ্ল্যাডিয়েটর স্যান্ডেল’ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোড়ালির একটু ওপরে ফিতা বাঁধা এই ফ্ল্যাট স্যান্ডেল বিভিন্ন রঙে পাওয়া যাচ্ছে। কারুকাজ করা স্যান্ডেলগুলোর কিছু তৈরি হয় দেশেই। আর কিছু আমদানি করা-এগুলো মূলত আসে চীন, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও ভারত থেকে। আমদানি করা স্যান্ডেলগুলোর বেশির ভাগ রেক্সিনের তৈরি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্রোকেডের কাজ করা। আবার অনেক সময় রেক্সিনের ওপর পাথর অথবা বড় ধরনের ধাতব বোতাম বসানো থাকে।
দেশি স্যান্ডেলগুলো একটু আলাদা। কাঠ, পুঁতি, পাথর, চুমকির এক সুনিপুণ সমাহার চোখে পড়বে চামড়া, সিল্ক, সুতি বা দুপিয়ান কাপড়ে তৈরি স্যান্ডেলগুলোতে। এ ছাড়া বর্ণিল লেস ও জরির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। দেশি স্যান্ডেলের মধ্যে এমব্রয়ডারির নকশাও শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া বার্মিজ দুই ফিতার জুতাগুলোও হালকার মধ্যে খুবই চমৎকার ও আরামদায়ক।
বেছে নিন পছন্দমতো
আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলিয়ে নির্বাচন করুন আপনার পছন্দের চটি।এ জুতা প্রায় সব পোশাকের সঙ্গেই পরা যায়। সালোয়ার-কামিজ, শাড়ির সঙ্গে তো যায়ই-চটি পরা যায় ফতুয়া, টপ, জিন্স, শার্ট, প্যান্ট ইত্যাদি পোশাকের সঙ্গেও। পোশাকের সঙ্গে চটির রংটা একটু মিলিয়ে পরলে ভালো দেখাবে। সব সময় ব্যবহারের জন্য চলতে পারে হালকা ওজনের কম কারুকাজ করা চটি।টপস, জিন্সের প্যান্ট বা ক্যাপ্রির সঙ্গে পরা যায় ফিতাওয়ালা গ্লাডিয়েটর স্যান্ডেল। এ ছাড়া বর্ণিল প্রজাপতি নকশাসহ বাহারি বার্মিজ জুতাও বেছে নিতে পারেন পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে।
জমকালো আয়োজনেও
কিছুদিন আগে পর্যন্ত কোনো অনুষ্ঠানের উপযোগী জমকালো পোশাকের সঙ্গে পেনসিল হিল বা হিল জুতার প্রচলন ছিল। এখন সেই জায়গাতেও কারুকাজ করা চমৎকার সব চটি জুতা দেখা যায়। বেশির ভাগ মেয়েই অনুষ্ঠানে এখন চটি জুতা পরছেন। সে ক্ষেত্রে সোনালি, রুপালি ও তামাটে রংটি বেছে নেওয়া যেতে পারে। ঝলমলে পোশাকের সঙ্গে নকশাদার, জরির কাজ করা জুতা পরা যায়। এ ছাড়া পাথর ও চুমকির কারুকাজ আছে এমন জুতাও বেছে নিতে পারেন। পোশাকের রং অনুযায়ী পাথর বসানো জুতাও ভালো মানাবে এ ক্ষেত্রে। কাচ, পুঁতি, লেইসের ফ্ল্যাট নাগরা পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। পছন্দের পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্বাচন করুন আপনার জমকালো জুতা।
যত্নের দিকে খেয়াল রাখুন
জুতা পায়ে থাকলেও এর দিকে খেয়াল না রাখলে পুরো সৌন্দর্যটাই মাটি হয়ে যায়। তাই এর যত্নের বিষয়টাও ভুলে গেলে চলবে না। খুব সুন্দর দামি একটি পোশাকের সঙ্গে যদি নিখুঁত জুতা পরে আপনার ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে চান, অবশ্যই জুতার ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে। বাইরে থেকে ফিরে শুকনো কাপড় দিয়ে জুতা মুছে র্যাকে রাখুন। কখনো ভেজা কাপড় দিয়ে জুতা মুছবেন না। এতে জুতার ঔজ্জ্বল্য কমে যায়। পাথর-পুঁতি আছে এমন জুতা নরম ব্রাশ দিয়ে হালকা করে মুছুন, যেন ধুলা জমে না থাকে। জুতা রাখার ক্ষেত্রে কখনোই র্যাকে একটির ওপর আরেকটি রাখবেন না। এতে জুতার আকৃতি ও কারুকাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কোথায় পাবেন
আড়ং
দুই ফিতার জুতা থেকে শুরু করে দেশীয় কারু করা করা পার্টি জুতাগুলো পাবেন ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকায়।
কাভা কাভা
সানরাইজ প্লাজার এ দোকানটিতে বিভিন্ন ডিজাইনের ফ্ল্যাট জুতা পাবেন ৪০০ থেকে ৯০০ টাকায়।
বাটা
আরামদায়ক ফ্ল্যাট জুতা পাবেন ২৫০ থেকে ৭৫০ টাকায়।
আলমাস সুপার শপ
২৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পড়বে ফ্ল্যাট জুতার দাম। বার্মিজ জুতাগুলোর দাম পড়বে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা।
এ ছাড়া মায়াসির, কে ক্রাফট, চাঁদনী চক, মেট্রো শপিং মল, এলিফ্যান্ট রোড, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি, নিউমার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে যাবেন আপনার প্রিয় ফ্ল্যাট জুতা।
শান্তা তাওহিদা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১১, ২০০৯
Leave a Reply