বাবা-মা তো সব সময় তাঁদের সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। তাঁরা চান, তাঁদের সন্তান বেড়ে উঠুক সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে; সফল হোক তার ভবিষ্যৎ জীবন। এ আশা থেকেই তাঁরা শিশুকে লালন করেন, ভালোবাসেন, স্মেহ দেন, আবার কখনো শাসনও করেন। উদ্দেশ্য একটাই-শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ। কিন্তু উদ্দেশ্য মহৎ হলেও অনেক সময় শিশুর প্রতি সঠিক আচরণ করা হয়ে ওঠে না। যখন দরকার স্মেহ আর ভালোবাসা, তখন হয়তো শাসন করা হয়; আবার যখন শাসন করা দরকার, তখন ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যান কোনো কোনো বাবা-মা। সামগ্রিক দিক বিচার-বিবেচনা করে মনোবিজ্ঞানীরা শিশুর প্রতি বাবা-মায়ের আচরণকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। ভাগগুলো হচ্ছেঃ
‘তোমাকে এটা করতেই হবে, নইলে···’
সব সময় শিশুর প্রতি কর্তৃত্ব করা, কড়া শাসনের বেড়াজালে তাকে আটকে রাখা, ‘এটা করতে হবে’, ‘ওটা করতে পারবে না’, ‘এক্ষুনি পড়তে বসো’, ‘যাও বলছি, ঘুমাতে যাও’, ‘খবরদার···’, ইত্যাদি বাচনভঙ্গি এ ধরনের বাবা-মায়ের নিত্যসঙ্গী। সাধারণত দেখা যায়, বাবা-মায়ের মধ্যে যেকোনো একজন এ ধরনের কর্তৃত্ব করেন, আর অন্যজন গোবেচারা হয়ে তাঁর সন্তানের সঙ্গে নিজেও কর্তৃত্বের শিকার হন! আবার কখনো দেখা যায়, বাবা-মা দুজন মিলেই সন্তানের ওপর চরম খবরদারি করেন। তাঁদের মতের ব্যত্যয় ঘটলে সন্তানের ওপর নেমে আসে শাস্তি। অর্থাৎ বাবা-মায়ের কথামতো না চললে, যখন তখন চড়-থাপ্পড় সন্তানের পাওনা হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের বাবা-মাকে বলা হয় ‘অথরিটরিয়ান’ বা কর্তৃত্বপরায়ণ বাবা-মা। এ ধরনের বাবা-মায়ের সন্তানের মনোজগৎ অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে ওঠে, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, সমাজের সঙ্গে মিশতে পারে না এবং ভবিষ্যৎ-জীবনে পিছিয়ে পড়ে, অসুখী হয়ে যায়। এ বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্য কঠিন, কঠোর নিয়ম-কানুন করে দেন, কিন্তু এ নিয়ম মেনে চললে কী সুফল পাবে, তা সন্তানকে ব্যাখ্যা করে বোঝান না। তাঁরা সব সময় কেবল হুঙ্কারই দেন, ‘আমি বলছি, তাই এটা করতে হবে। কোনো প্রশ্ন করা চলবে না, এক্ষুনি এটা করো, নইলে আজ তোমার কপালে পিটুনি আছে।’ কর্তৃত্বপরায়ণ বাবা-মায়েরা মনে করেন, তাঁরাই সন্তানের সবচেয়ে ভালো চান। তাই তাঁরা যেভাবে চান, সেভাবেই ওর চলা উচিত।
‘না মানে হচ্ছে না, তবে তুমি ভেবে দেখো-কোনটা ভালো···’
এ ধরনের বাবা-মা সন্তানের প্রতি নিয়ম-কানুন আরোপ করেন, তবে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তির পরিবর্তে নিয়মের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। বুঝিয়ে বলেন কেন একটি কাজ করা উচিত নয়, আর কেনই বা কাজটি করতে হবে। তাঁরা সন্তানের আকাঙ্ক্ষিত আচরণকে উৎসাহিত করেন, পুরস্কৃত করেন। অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য শাস্তি দেন না। সব সময় ধমকের সুরে কথা বলেন না। সন্তানের বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত তাঁরা ওদের সঙ্গে আলোচনা করেই নেন। বাবা-মায়ের এ ধরনটিকে বলা হয় ‘অথরিটেটিভ-রেসিপ্রোকাল’ বা পারস্পরিক নির্ভরযোগ্যতা। চার ধরনের বাবা-মায়ের মধ্যে তাঁরাই আদর্শ। তাঁদের সন্তানের আত্মবিশ্বাস বেশি হয়, তারা সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল হয়ে গড়ে ওঠে এবং ভবিষ্যৎ-জীবন সাফল্যমণ্ডিত হয়। তারা মানসিক চাপ ও প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় দক্ষ হয়ে ওঠে এবং তাদের নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জিত হয়। এ ধরনের বাবা-মা অনেকটা স্বাধীনভাবে তাঁদের সন্তানকে বেড়ে উঠতে দিলেও নিয়ম-নীতির বাইরে যাতে ওরা যেতে না পারে, সেদিকে সতর্ক নজর রাখেন। এ বাবা-মায়ের সন্তানেরা বন্ধুসুলভ হয়, তারা সামাজিকতা পালন করে আর ভবিষ্যতে নিজেরাও ভালো বাবা/মা হিসেবে গড়ে ওঠে।
‘তুমি যা চাও, তা-ই করো···, যা চাও, তাই দেব তোমায়’
সন্তানের প্রতি এ ধরনের বাবা-মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সন্তান যা খুশি তা-ই করে। ঢালাও প্রশ্রয় পায় বাবা-মায়ের কাছে। কোনো বাসায় গিয়ে ইচ্ছামতো ভাঙচুর, দুষ্টুমি করলে বা অতিচঞ্চলতা দেখালেও বাবা-মায়েরা সন্তানের কোনো আচরণকেই নিয়ন্ত্রণ করেন না। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সন্তানের চাহিদামতো টাকা-পয়সা দেন, যখন যা চায় তা-ই কিনে দেন। তাঁরা খুব বেশি ভালোবাসায় গদগদ হয়ে সন্তানের কোনো আচরণকেই চ্যালেঞ্জ করেন না। সাধারণত বেশি বয়সে বাবা-মা হলে সন্তানের প্রতি এমন মনোভাব দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, বাবা-মায়ের এ আচরণকে বলা হয় ‘ইনডালজেন্ট-পারমিসিভ’ বা প্রশ্রয়পূর্ণ আচরণ। অনেক কিছু প্রশ্রয় দিতে দিতে কখনো বা সন্তানের সামান্য বিচ্যুতিতে তাঁরা অসামঞ্জস্যপূর্ণ কঠিন শাস্তি দিয়ে বসেন। এ ধরনের বাবা-মায়ের সন্তানেরা উগ্র মেজাজের ও হতাশাগ্রস্ত হয়। তারা হঠকারী আচরণ করে, তাদের ভবিষ্যৎ-জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের ভালো বন্ধু গড়ে ওঠে না, বয়োসন্ধিতে নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। তারা নেশা ও বিভিন্ন অপরাধমূলক তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে।
‘তুমি তোমার ইচ্ছামতো চলো, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না···’
এ ধরনের বাবা-মা সন্তানকে প্রায় উপেক্ষা করেন। সন্তান কী করে, কোথায় যায়, কী চায়-এসব নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। সন্তানের সঙ্গে তাঁদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। এ ধরনের আচরণকে বলা হয় ‘ইনডালজেন্ট-নেগলেক্টফুল’ বা উপেক্ষাপূর্ণ আচরণ। যদি বাবা-মায়ের সম্পর্ক খারাপ থাকে, তবে তাঁরা সাধারণত এ ধরনের আচরণ করে থাকেন। ইনডালজেন্ট-পারমিসিভের সঙ্গে এর পার্থক্য হচ্ছে, এখানে সন্তানকে অধিক ভালোবেসে নয়, বরং উপেক্ষা করে তার সব আচরণ প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এ ধরনের বাবা-মায়ের সন্তানেরা সামাজিকতার শিক্ষা পায় না, উগ্র মেজাজের হয় এবং তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। যে চার ধরনের বাবা-মায়ের কথা বলা হলো এর বাইরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিশ্র আচরণের বাবা-মা দেখা যায়। কখনো বাবার এক ধরনের, আবার মায়ের এক ধরনের আচরণ হতে পারে। কিন্তু সন্তানের মনোজগৎ সঠিকভাবে গড়ে তুলতে আর তার ভবিষ্যৎ-জীবন সুন্দর করতে বাবা-মায়ের আচরণ হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ ও হিসাবি। অপরিমিত কঠোরতা, অন্ধস্মেহ বা উপেক্ষা সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সন্তানের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবেন
তাকে যে ভালোবাসেন, তা সরাসরি প্রকাশ করুন। কোলে নিন, চুমু দিন, তার দিকে তাকিয়ে হাসুন।
সে যখন আপনাকে কোনো কিছু বলতে চায়, তখন তার দিকে মনোযোগ দিন। বিরক্তির ভাব না দেখিয়ে হাতের কাজ ফেলে তার দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনুন। পত্রিকা পড়া সাময়িক বন্ধ রেখে বা টিভির কোনো অনুষ্ঠানের দিক থেকে সামান্য সময়ের জন্য মনোযোগ সরিয়ে সন্তানের দিকে মনোযোগ দিন।
সন্তানকে খানিকটা ঝুঁকি নিতে শেখান। দৌড়ালে পড়ে যাবে-এ ভয়ে তাকে দৌড়াতে না দেওয়া উচিত হবে না। সাইকেল চালাতে গেলে ব্যথা পাবে ভেবে সাইকেলে চড়তে না দেওয়া বোকামি হবে।
কেবল সফলতা নয়, কখনো ব্যর্থতার সঙ্গেও তাকে পরিচয় করিয়ে দিন। নাচ-গানে আপনার সন্তানকে প্রথম হতেই হবে, অঙ্কন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার আনতেই হবে-এ মনোভাব না নিয়ে তাকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের গুরুত্ব বোঝান, পুরস্কারের গুরুত্ব নয়। ব্যর্থতায় তার সমালোচনা করবেন না, বরং সফলতার মতো ব্যর্থতাও যে প্রতিযোগিতার একটা অনুষঙ্গ, তাকে তা বুঝতে সাহায্য করুন।
শিশুদের প্রতি ‘হ্যাঁ’ তো বলবেনই, কিন্তু কখন, কোন পরিস্থিতিতে তাকে কোন কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে, সেটা মনে রেখে কখনো ‘না’-ও বলুন।
কিসে সে খুশি হয়, কিসে দুঃখ পায় তা বোঝার চেষ্টা করুন এবং সেভাবেই আচরণ করুন।
তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে তার নিজের জগৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করুন।
ভালো কাজের জন্য তাকে উৎসাহ দিন, আর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য শাস্তির বদলে পুরস্কার প্রত্যাহার করুন।
তার সামনে কোনো অপরাধ করা থেকে বা অপরাধের পক্ষ নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
শিশুর সামনে পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন, দাম্পত্য কলহ থেকে বিরত থাকুন।
ডা· আহমেদ হেলাল
লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১১, ২০০৯
Leave a Reply