বিশ্বব্যাপী হ্যাকিং নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ। হ্যাকিং প্রবণতার আরও বিস্তার ঘটিয়েছে হ্যাকাররা আন্তর্জাতিক মেলার আয়োজন করে। হ্যাকিং-এর পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে বেড়েই চলেছে অনলাইন ক্রাইম বা সাইবার ক্রাইম। সাইবার অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িতদের নেই কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা। পুরো বিশ্বই তাদের অপরাধের বিশাল ক্ষেত্র, বিশ্বকে তারা সাইবার অপরাধের একক ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বিভিন্নভাবে এসব অপরাধী তাদের হীনকর কর্মকান্ড যথেচ্ছাই চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কোটি কোটি লোক। সাইবার অপরাধীরা এসব কর্মকান্ডকে তাদের আয় উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং লাভজনকভাবে পুরো বিশ্বকে এক ভেবে ইন্টারনেটে অপরাধ করেই যাচ্ছে। সাইবার অপরাধ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে পশ্চিম ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে এবং এসব অপরাধ মূলত ডিজিটাল অপরাধসমূহ আর্থিকভাবে খুবই লোভনীয় হওয়ার পাশাপাশি এসব অপরাধের দন্ড প্রদান ব্যবস্থাও অপ্রতুল। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিচার বিভাগের সাইবার অপরাধের দেশীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন তথ্যপূর্ণ পরিসংখ্যান নেই। তবে তাদের অভিমত এই যে যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এ সমস্যা বেড়েই চলেছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ হলো প্রতি ১ ঘন্টায় প্রায় ৩০০০০ স্প্যাম মেইল বিভিন্ন ইনবক্স আসে যার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফিশিং এর মাধ্যমে সাইবার অপরাধের ক্রমবর্ধনশীল অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশকে ভাবিয়ে তুলেছে। ইউএন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এ অপরাধে নিকোল রোমান নামে এক অপরাধীকে বুলগেরিয়া হতে ফিরিয়ে এনে ৫০ মাসের জেল দিয়েছে। যদিও হাজার হাজার অপরাধী এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এসব সাইবার অপরাধ দমনে কার্যক্রম খুবই তোড়জোড় শুরু করেছে। হিলারী ক্লিনটন ও রোমানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত মে মাসের ৮ তারিখে এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি করেছে। ফিশিং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মূলত গত বছর থেকে সাইবার অপরাধ দমন পুরোদমে কাজ শুরু করলেও বিশ্বের অনেক দেশ এখনও এসব বিষয়ে কোন অগ্রগতিই করতে পারেনি। এসব কার্যক্রমের ফলে ফিশিং অপরাধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪০ জন অপরাধীকে ধরতে পেরেছে। গত বছর আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে ১০টিরও বেশি হ্যাকিং সংগঠন রয়েছে যেগুলোর অবস্থান ইউক্রেন, ইস্তোনিয়া, চীন ও বেলারুশ এ। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ক্রেডিট কার্ড হ্যাকিং হয় এবং ক্ষতিকারী ওয়েব মেক্কলু বন্ধ করার পর মেইলে স্পাম প্রেরণ প্রায় ৭৫ ভাগ কমলেও, সিমানটেক এর মে ’০৯ মাসের তথ্য থেকে দেখা যায় যে সকল মেইলের ৯০ ভাগই স্পাম এবং এপ্রিল হতে মে’তে বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ ভাগ। বর্তমানে বিশ্বের সাইবার অপরাধ দমনে শুধু নিজ দেশ সচেষ্ট হলেই হবে না দেশী-বিদেশী সরকারি-বেসরকারি সকল খাতের সাথেই সমন্বয়ের মাধ্যমে অপরাধ মোকাবেলা করতে হবে।
বর্তমান সময়ের কয়েকটি ক্ষতিকর কুখ্যাত সাইবার ক্রাইম টুল
ফিশিং স্প্যাম
এর মাধ্যমে মূলত ব্যাংক নোটিশ, ট্রাংক নম্বর ইত্যাদি স্পামের মাধ্যমে প্রেরণ করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে তাদের তথ্য লুট সহ ব্যাংক একাউন্ট হতে অর্থ লুট করা হয়। ফিশিং স্প্যাম মূলত মেইলের মাধ্যমে গ্রাহকের তথ্য চুরি করে অর্থ কামিয়ে নেয়।
স্টক স্প্যাম
বিগত কয়েক বছরে নতুন একধরনের স্প্যাম ওয়েব নিয়ে সাইবার অপরাধীরা ব্যাপক তৎপর তা হলো স্টক স্প্যাম। এর মাধ্যমে অপরাধীরা গ্রাহকদের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনতে অনুপ্রাণিত করে এবং নিজেরা এসব পয়সা হাতিয়ে নেয়। ৫২ বছর বয়স্ক এলওন গত এক বছরে চাইনিজ স্টকের নামে প্রায় মিলিয়ন মিলিয়ন স্পাম মেইল পাঠিয়ে গ্রাহকদের ঠকিয়েছে। সিকিউরিটি ও এক্সচেঞ্জ সংস্থা সমূহ এসব নিয়ে কাজ করলেও লক্ষ লক্ষ অপরাধী এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
ডিডিওএস (ডিস্ট্রিবিউটেড ডেনিয়েল অব সার্ভিস)
ফিশার ও ডাটা চোররা যখন পারে তখন ডাটা চুরি করে। তাদের বহুল প্রচলিত ডিডিওএস এর মাধ্যমে বিভিন্ন সফটওয়্যার লুকিয়ে গ্রহকদের পিসিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয় এবং এর মাধ্যমে তথ্য চুরি করে। মে মাসে ১৯ বছরের ফিমিত্রি গুজনার তার এহেন অপকর্মের স্বীকার করেন, সে কিভাবে বিভিন্ন সায়েন্স ওয়েব থেকে তথ্য লুট করে তা স্বীকার করেছে।
সটিং
সটিং হলো অপরাধীদের নির্ধারিত ব্যক্তিদের ফোনের একাউন্টে অনুপ্রেবেশ করে ফোন একাউন্টের তথ্য নিয়ে কোম্পানিসমূহের তথ্য ও কোম্পানির কর্মকর্তাদেরও তথ্য চুরি করা হয়। এর মাধ্যমে তারা গ্রাহক, ব্যক্তির ফোন ব্যবহার করে পুলিশকে ফোন দিয়ে বলা হয় যেন সোয়াত টিম পাঠিয়ে তার সমস্যা সমাধান করে এবং এতে আক্রান্ত ব্যক্তি অযথাই হেনস্তা হন।
অভ্যন্তরীণ ডাটা চুরি
অনেকেই ইউএসবির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে পরিচিতজনদের তথ্য চুরি করে বিক্রি করে দেয় হ্যাকারদের কাছে। এর ফলে রিবুলো নামের একজন ধরা খেয়ে এখন ৫ বছরের সাজা প্রাপ্ত।
পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য চুরি
পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য চুরির জন্য বেশি জ্ঞানী হতে হয় না। শুধু আগ্রহী হয়ে একটু গবেষণা করলেই হয়। মূলত জন ডাটাবেজ হতে তথ্য নিয়ে কোন এক ‘লক্ষ্য’ ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য নিয়ে যেকোনো একটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর হ্যাকের মাধ্যমে প্রদান করে, ব্যাংকের কাছে আবেদন করে আক্রান্ত ব্যক্তির একাউন্ট হতে অর্থ তুলে লুট করা হয়।
এডওয়্যার
যদিও এডওয়্যার এখন তেমন ব্যাপক নয়, তবুও অপরাধীরা এখন এর মাধ্যমে করছে হাজার হাজার অপরাধ। লুটে নিচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। এডওয়্যারের মাধ্যমে সহজে লক্ষ লক্ষ পিসি’তে ঢুকে সহজেই লক্ষ লক্ষ পিসি হ্যাক করা যায়। এ কাজ করে ৫ বছরের জেল হয়েছে ২১ বছরের বরার্ট মেথিউ-এর। অবশ্য এডওয়্যারে যারা ব্যাপক সংঘবদ্ধ এবং এ কাজ তারা একত্রিতভাবে টার্গেট করে, ফলে ব্যর্থতা কম, বরং ফলপ্রসূ।
নকল সফটওয়্যার
নকল সফটওয়্যার পরিবেশন ও বিক্রি একটি সাধারণ অপরাধ। যা সহজেই করা যায়। প্রতিদিন সফটওয়্যার নকল করার মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লেনদেন হয় এবং এক্ষেত্রে আয়ও অন্যান্য যেকোন অপরাধের চেয়ে বেশি, ঝুঁকিও কম। বিশ্বের বহু দেশে এখন ব্র্যান্ডের আইটেম সমূহ নকল করে বিক্রি হয় এবং সবাই তা ব্যবহারও করছে। সাইবার অপরাধীদের ব্যাপ্তি এখন সর্বত্র। ডিজিটাল যুগের সাইবার অপরাধীরা হলো ডিজিটাল অপরাধী, এদের দমন সত্যিই কষ্টসাধ্য হবে।
পরিশেষে বলা যায় মানব কল্যাণের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ধ্বংসের বিষদাঁতটাও কম ধাঁরালো নয়। আমাদের সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি এমনই এক ক্ষতিকর দিক হলো সাইবার বুলি। সাইবার বুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে গেলে যখন কেউ তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমকেও (যেমন : মোবাইল, মেসেজ রিসিভার, ইমেইল) ব্যবহার করে নানান হুমকি প্রদান করে। এটি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ছাপিয়ে আমাদের দেশেও কার্যকর। এই জন্য এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
ড় আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ০১, ২০০৯
Leave a Reply