আসবাবে সৃজনশীলতার ছোঁয়া ঘরে এনে দেয় পরিপূর্ণতা। আর আসবাবকে সৃজনশীল ও আরামদায়ক করে কীভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, এ বিষয়ে দীর্ঘদিন চিন্তাভাবনা করে ব্যতিক্রমী আসবাব তৈরি করছেন বেন্টউডের স্বত্বাধিকারী আসবাব ডিজাইনার টুকু সাদউল্লাহ।
এইচএসসি পাস করে ১৯৬৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন বিমানবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ দেশে ফিরে আসেন তিনি। এর কিছুদিন পর তিনি লন্ডনে যান বৈমানিকের লাইসেন্স আনার জন্য। সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় ডিজাইন স্কুলের এক ছাত্রের সঙ্গে। ওই ছাত্রের সঙ্গে মাত্র আধ ঘণ্টার আলাপচারিতায় জীবনের মোড় ঘুরে যায় তাঁর। পরে ভর্তি হন মিডলশারীরিক মিলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ে। তারপর পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে এসে শুরু করলেন কাঠের আসবাব এবং মেঝে তৈরির কাজ। একদিন তাঁর এক বন্ধুপ্রতিম মানুষ গ্যাস্ট্রোলিভার ক্লিনিকের ডা· মহসিন তাঁকে বললেন, ‘আমাকে এমন ধরনের কয়েকটি চেয়ার তৈরি করে দেন, যে চেয়ারে বসলে অস্ত্রোপচারের পর রোগীরা আরাম অনুভব করবে এবং সেখানে বসার পর তাদের শরীরে হালকা ধরনের ঝাঁকুনির অনুভূতি হবে। আর এই ঝাঁকুনিই তাদের অস্ত্রোপচারের ঘা শুকাতে সাহায্য করবে।’ এই ভাবনা থেকেই বেন্টউড নিয়ে কাজ শুরু করেন টুকু সাদউল্লাহ।
বেন্টউডের আসবাবের বৈশিষ্ট্য হলো, এর তৈরি চেয়ারে বসলে শরীরে হালকা দুলুনির এক আরামদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আর খুব সহজেই স্ক্রু খুলে খণ্ডে খণ্ডে ভাঁজ করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। এ ধরনের আসবাব খুব দৃষ্টিনন্দন হয়ে থাকে। একসময় বেন্টউড দিয়ে তিনি জোড়াবিহীন আসবাস তৈরি করতেন। তিনি মনে করেন, মানুষ সব সময় চায় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে। আর এ ধরনের ভাবনা থেকেই তিনি কাঠের মেঝে তৈরি করেন। কাঠ দিয়ে তৈরি ছায়ানটের সংস্কৃতি ভবনের মঞ্চটিও তাঁর করা। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এবং আবাসিক ইমারতে কাঠের মেঝের ডিজাইন করে থাকেন।
প্রায় ২০ বছর ধরে বেন্টউডের ওপর কাজ করছেন টুকু সাদউল্লাহ। সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তির সঙ্গে সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে বেন্টউডের আসবাব তৈরি করেন তিনি। সব সময়ই নতুন কিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। আর এ জন্য এই কাজে তিনি ব্যবহার করেন এমন কিছু গাছের কাঠ, যা আসবাবশিল্পে তেমন ব্যবহৃত হয় না। যেমন রেইনট্রি, কড়ই, চা-বাগানে ছায়া দেয় এমন কিছু গাছ। আমাদের দেশে গাছপালা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তারপর আসবাবের জন্য গাছ কাটা হলে, তা বনভূমির জন্য হুমকিস্বরূপ হবে। এ জন্যই কম দামি, সহজলভ্য এবং চারা রোপণ করার পর ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে যে গাছ পরিপূর্ণতা পায়, এর কাঠ নিয়েই কাজ করেন তিনি। এ ধরনের কাঠের আসবাবের দীর্ঘস্থায়িত্ব কতটুকু? এ সম্পর্কে তিনি জানান, সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এসব কাঠের উপযোগিতা সৃষ্টি করে আসবাব তৈরি করা হলে তা ১০ থেকে ১২ বছর স্থায়ী হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বেন্টউডের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের আসবাবশিল্পে বেন্টউডের বাজার সৃষ্টি করা হলে তা আন্তর্জাতিক আসবাবশিল্পের বাজারে বাংলাদেশকে একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। আর এ লক্ষ্যেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। নতুন প্রজন্মকে হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে আমাদের দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় আসবাবের প্রতিষ্ঠান তাঁর এই প্রযুক্তিগত ধারণাকে কাজে লাগিয়ে বেন্টউডের আসবাব তৈরি করছে। এখন টুকু সাদউল্লাহর বাড়িতে খুব ছোট পরিসরে রয়েছে বেন্টউডের কারখানা। চাইলে আপনিও সেখানে গিয়ে দেখে ফরমায়েশ দিয়ে বানাতে পারেন আপনার মনের মতো বেন্টউডের আসবাব এবং কাঠের মেঝের ডিজাইনও করিয়ে নিতে পারেন। আসবাবের দাম নির্ধারণ করা হয় ডিজাইন ও নির্মাণশৈলীর ওপর ভিত্তি করে এবং কাঠের মেঝে দাম পড়বে প্রতি বর্গফুট ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। যোগাযোগঃ ১৩৭/ই, জাহানারা গার্ডেন, গ্রীন রোড, ঢাকা।
বিপাশা রায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৮, ২০০৯
Leave a Reply