আমাদের সন্তানেরা যখন ছোট থাকে তখন ভাবি, ও কখন বড় হবে। কবে হাঁটতে শিখবে। ওরা একসময় হামাগুড়ি ছেড়ে হাঁটতে শেখে। তখন ভাবি, ‘এই তো আর কদিন। বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু হলে আমাদের আর ওকে চোখে চোখে রাখতে হবে না।’ সন্তানদের স্কুলে দিয়ে বাইরে বসে থাকি আর ভাবি, ‘এই তো উচ্চবিদ্যালয়ে গেলে আর কোনো টেনশন থাকবে না।’ আমরা কি আসলেই টেনশনমুক্ত হতে পারি? সন্তান বড় হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়ে উচ্চবিদ্যালয়ে যায়। উচ্চবিদ্যালয় ছেড়ে মহাবিদ্যালয়; তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও আমাদের দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ শেষ হয় না। যাদের নিয়ে এত চিন্তা আর দুশ্চিন্তা, তাদের ভাষা আমরা কতটুকু বুঝি? এই প্রশ্নটি আমার ভাবিকে করতেই লম্বা উত্তর পাই। ‘ওদের বুঝি না মানে! ওদের পেটে ধরেছি না? ওদের নাড়িনক্ষত্র সব বুঝি।’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘ওদের মনের খবর কতটুকু জানেন?’ ভাবি রান্না বন্ধ করে আমাকে বোঝানো শুরু করেন, ‘শোনো, আমি হচ্ছি ওদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমরা বন্ধুর মতো কথা বলি। ওরা সবকিছু আমাকে বলে।’ আমি নরম সুরে জিজ্ঞেস করি, ‘ওরা সবকিছু কি আপনাকে বলে?’ ভাবির ওই একই উত্তর, ‘সব বলে। আমি তো শুধু ওদের মা নই; আমি ওদের বন্ধু।’ কথাটা শুনে আমার কাছে খটকা লাগে। আমি ভাবিকে ছোটখাটো একটা পরীক্ষায় ফেলে দিই। বলি, ‘ধরুন আপনার ছেলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখার জন্য ওর এক বন্ধুকে অনুরোধ করল। ওর বন্ধু কি ওর সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাবে?’ ভাবি একটু চিন্তা করে বললেন, ‘যেতেও পারে।’ এবার আসল প্রশ্নটি করলাম, ‘আপনার ছেলে যদি স্কুল ফাঁকি দিয়ে আপনাকে সিনেমা দেখতে যেতে বলে, আপনি যাবেন?’ ভাবি বিরক্ত হলেন, ‘পাগল নাকি! ও স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাবে আর আমি ওর সঙ্গে গিয়ে ওকে সাপোর্ট দেব? এটা একটা কথা হলো!’ আমি বললাম, ‘ঠিক বলেছেন ভাবি। এটা কোনো কথাই হলো না। ওর বন্ধুরা যেটা করতে পারে, আপনি সেটা করতে পারেন না। কারণ আপনি চেষ্টা করলেও আপনার সন্তানের বন্ধু হতে পারবেন না এবং এমন চেষ্টা করাও উচিত নয়।’ ভাবি ততক্ষণে বেশ উত্তেজিত হয়ে গেছেন। আমি বলি, ‘ভেবে দেখুন, একজন ১৩-১৪ বছরের ছেলে বা মেয়ে তার বন্ধু হিসেবে তারই বয়সী কাউকে বেশি পচ্ছন্দ করবে, যার সঙ্গে সে তার বেড়ে ওঠার আনন্দ-কৌতূহল নিয়ে কথা বলবে। একজন ৩০ বছরের মানুষ শত চেষ্টা করলেও ১৪ বছরের কিশোর-কিশোরীর ভালো বন্ধু হতে পারবে না। এটা বয়সের কারণেই সম্ভব নয়। অতএব উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের তাদের মতো করে বেড়ে উঠতে দেওয়ার কারণে হলেও আমাদের ওই বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বিরক্ত করার কোনো কারণ নেই।’
ভাবি আমার কথাটা পচ্ছন্দ করেননি। বাবা-মা হিসেবে এই সত্যটা মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর। ‘তার মানে কি ওরা একটু বড় হলে ওদের একেবারেই ছেড়ে দেব? ওদের কোনো বিষয়েই কোনো খোঁজ নেব না?’ আমি ভাবিকে শান্ত করার চেষ্টা করি, ‘তা কেন। আমরা অবশ্যই আমাদের সন্তানদের খোঁজখবর নেব। আমরা চাই আমাদের সন্তানেরা একজন পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠুক। এই বড় হয়ে ওঠার যাত্রায় আমরা ওদের সহযোগিতা করব। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করব না।’
আমার কাছে যত কিশোর-কিশোরী সাহায্যের জন্য আসে, তাদের একটিই কথা, ‘আমার বাবা-মা আমার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কী খাব, কী পরব, কোথায় যাব, কার সঙ্গে কথা বলব, ভবিষ্যতে কী হব-এই সবকিছুই বাবা-মা ঠিক করে দিতে চায়। আমি কেন আমারটা ঠিক করতে পারব না? আমি তো একজন মানুষ। আমারও তো নিজের পচ্ছন্দ আছে। আমি কি পুতুল?’ আমি ওদের কষ্টটা বুঝি। কিন্তু বাবা-মা কি সত্যি নিয়ন্ত্রণ করেন, নাকি নিজেদের শঙ্কা, ভয় আর দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য ছেলেমেয়েকে আঁকড়ে ধরতে চান? আসলে যা হয়, তা হলো সন্তান যত বড় হয় বাবা-মার মধ্যে তৈরি হয় ‘সেপারেশন অ্যাংজাইটি’। বাবা-মা ভাবেন যে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের হারাচ্ছেন। তাঁরা বুঝতে চান না যে তাঁদের সন্তানেরা ধীরে ধীরে নিজেদের জগৎ তৈরি করছে। এই জগৎটার তিনটা অংশ। প্রথম অংশ সর্বসাধারণের জন্য খোলা। বাবা, মা, ভাইবোন, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক-সবাই এই জগতের খবর পান। যেমন আপনার সন্তান কী পড়াশোনা করছে, অবসরে কী করে-যেমন নাটক, খেলাধুলা, আবৃত্তি, গান ইত্যাদি। এবার বলি দ্বিতীয় অংশের কথা। দ্বিতীয় অংশে সবার প্রবেশাধিকার নেই। সেখানে কেবল আপনার সন্তানের বন্ধুদের আনাগোনা। বন্ধুদের সঙ্গে ওরা বেড়ে ওঠে। জগৎ এবং বেড়ে ওঠার নানা কৌতূহল আর উত্তেজনা তখন তাদের সাথি। এই অংশে যদিও ওরা চায় না যে অন্য কেউ ওদের কথা জানুক, তবে বাবা-মা ভাইবোন সেই জগতের কিছুটা আঁচ করতে পারে। আর তৃতীয় অংশে কারও প্রবেশাধিকার নেই। এই জগতে কেবল আপনার সন্তানের প্রবেশাধিকার। এখানে সে কাউকে ঢুকতে দেবে না। এটা ওর নিজের জগৎ। নিজের সঙ্গে নিজে সারা দিন কথা বলে, দিবাস্বপ্ন দেখে। একা একা কত কিছু ভাবে, কত কিছু বলে! ওর ইচ্ছে হলে এই জগতের কিছু কথা অন্য কাউকে বলতে পারে। কিন্তু কাউকে সে এই জগতে প্রবেশ করতে দেবে না। এটা কেবলই ওর জগৎ।
আপনার সন্তান এই যে তিনটি জগৎ বানিয়ে নিয়েছে, এতে দোষের কিছু নেই। এটা বেড়ে ওঠার সাধারণ প্রক্রিয়া। সমস্যা হচ্ছে, যখন ওর তিন জগতেই আপনি উঁকি মারতে চান।
‘না না, এটা ঠিক বলোনি।’ ভাবির সোজাসাপটা উত্তর, ‘ওর জগৎ তো আমাদের নিয়ে।’
ভুলটা এখানেই। আমাদের সন্তান যদি কেবল আমাদের বলয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে সে জগতের বিশাল বলয়ে হিমশিম খাবে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ ভিন্ন। তাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলোও ভিন্ন। বাবা-মা হিসেবে আমরা ওদের আমাদের ভালো গুণগুলো দিয়ে প্রভাবিত করতে পারি। কিন্তু যখনই ওদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইব তখনই শুনতে হবে, ‘আমার কি কোনো স্বাধীনতা নেই? আমার কি কোনো প্রাইভেসি নেই?’
এবার ভাবির করুণ আর্তি, ‘তাহলে কী করব?’
আমি বলি, ‘ওদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন। ওরা অনেক কিছু বলতে চায় । ভাবুন তো সেই কথাগুলো, যদি বাবা-মা না বোঝেন, তাহলে ওরা কোথায় যাবে!’
জন মার্টিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৮, ২০০৯
masud
realy nice i read all thanks who write all this , wish u best of luck