মৌপিয়ার বিয়ে হয়েছে দুই বছর হলো। এই দুই বছরে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে কি না, তাঁর মনে পড়ে না। সংসারে স্বামী তৌফিক ছাড়াও আছে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ। একসঙ্গে থাকেন বলে দাম্পত্য জীবনে কি কোনো সমস্যা হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে মৌপিয়া বললেন, ‘আমাদের দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া বেশ ভালো। বিয়ের আগে বেশ কয়েক বছর একটা সম্পর্ক থাকায় স্বামী-স্ত্রীর পাশাপাশি আমরা একে অন্যের বন্ধুও। তবে ভালোবাসার সম্পর্কের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কের পার্থক্য রয়েছে। এর পরও দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে পারস্পরিক বোঝাপড়াটাই আসল।’
মৌপিয়া ও তৌফিক কিছু নিয়ম মেনে চলেন। যেমন-কোনো বিষয়ে রাগ হলে চেঁচামেচি করা যাবে না; কেউ কারও কাছে খুব বেশি কিছু আশা করবে না। একে অন্যের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না। চেষ্টা করবেন কথা দিয়ে কথা রাখতে; না রাখতে পারলে অবশ্যই বুঝিয়ে বলবেন। নিজেদের সমস্যাগুলো নিজেরাই সমাধান করবেন।
নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের সুখময় দাম্পত্যের পূর্বশর্ত হিসেবে ভালোবাসাটাকেই রাখেন সবার আগে। তাঁর মতে, এই বন্ধনে কোনো রক্তসম্পর্ক তো নেই; যে সম্পর্ক রয়েছে তা হলো আস্থা ও বিশ্বাসের, যা ভালোবাসা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিত্তিটাই হলো ভালোবাসা। সেই সঙ্গে সম্মানটাও দিতে হবে। সারা যাকের বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, সংসারে সুখের জন্য কোনো কাজই কেবল ছেলেদের জন্য নয়, আবার কোনোটিই কেবল মেয়েদের জন্য নয়; বরং নারী-পুরুষের সমন্বিত কাজেই সংসারে সুখ-শান্তি বজায় থাকে। যেমন, বাজার করাটা শুধু ছেলেদের কাজ আর রান্না করাটা মেয়েদের কাজ-এ ধরনের ধারণাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের দায়িত্বটাও ভাগাভাগি করে নিতে হবে।
দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তিতে থাকতে হলে একজনের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। স্বামীর কাজের প্রতি স্ত্রী যেমন শ্রদ্ধাশীল থাকবেন, তেমনি স্ত্রীর কাজের প্রতি স্বামীকেও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
সারা যাকের মনে করেন, দাম্পত্য জীবনে আনন্দের জন্য নিজেদের কিছু কিছু ভালোলাগার বিষয় তৈরি করে নিতে হবে। এমন হতে পারে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সঙ্গীর পছন্দের কোনো একটি জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার অয়োজন করা যেতে পারে। একসঙ্গে চমৎকার কোনো রোমান্টিক সিনেমা দেখা যেতে পারে। উদ্যাপন করতে পারেন ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্ত।
‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান, সহনশীলতার মাধ্যমেই ভালোবাসার এই চর্চা করা সম্ভব। তাই সুখী দাম্পত্যের লক্ষ্যে আমাদের কিছু কাজ করা উচিত এবং কিছু কাজ করা উচিত নয়।’ বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম।
দাম্পত্যে যা করবেন
মেহতাব খানম মনে করেন, স্বামী-স্ত্রী দুজন যেহেতু ভিন্ন দুটি পরিবার থেকে এসে একসঙ্গে বসবাস করেন তাই তাঁদের মধ্যে কিছু কিছু অমিল থাকতেই পারে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে হয়তো দুজন কিছুতেই একমত হতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে যাঁর যাঁর মত প্রকাশের ক্ষেত্রে যেমন স্বাধীনতা থাকবে তেমনি অন্যের মতামতের প্রতি হতে হবে শ্রদ্ধাশীল।
যেমন একটি সিনেমা দেখার পর হয়তো একজনের কাছে ভালো লেগেছে অন্যের কাছে একদমই ভালো লাগেনি। সে ক্ষেত্রে ভালো লাগা এবং না লাগার কারণগুলো নিজেদের মধ্যে বিশ্লেষণ করতে পারেন। কিন্তু কখনোই ‘কী করে তোমার এটা ভালো লাগল’ বা ‘ভালো লাগেনি? তাহলে তো তুমি সিনেমাই বোঝো না’ এই ধরনের মন্তব্য করা ঠিক নয়।
— একজন আরেকজনকে প্রতিদিনই অন্তত একবার করে ভালোবাসার কথা জানাতে পারেন।
— প্রতিদিনই ছোট-বড় অনেক কাজে দম্পতিরা একে অন্যের সাহায্য নিয়েই থাকেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রতিবারই সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ দিতে ভুলবেন না সঙ্গীকে।
— আপনার স্বামী বা স্ত্রী নিশ্চয়ই অনেক গুণে গুণান্বিত। তার গুণের প্রশংসা করুন সময় পেলেই। তেমনিভাবে তার দুর্বলতা কোথাও তাও জানিয়ে দিন।
— চেষ্টা করতে হবে সঙ্গীকে বিভিন্ন কারণে বিভিন্নভাবে চমকে দিতে। কিছুই করার না থাকলে অন্তত হাত ধরে হেঁটে আসুন খানিকটা পথ।
— ছোটখাটো ভুলেও ক্ষমা চেয়ে নিতে পারেন। তাতে কেউ কারও কাছে ছোট হয়ে যাবেন না। বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা হবে।
— সন্তানের ভালো-মন্দ যেকোনো বিষয়ে দুজনের দায়িত্ব স্বীকার করে নিন। অন্যের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না।
দাম্পত্যে করতে মানা
— স্বামী বা স্ত্রীর কাছ থেকে বেশি কিছু আশা না করাই ভালো-মনে করেন বিজ্ঞজনেরা।
— সঙ্গীকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা না করাই ভালো। যেমন-সবার সামনে সঙ্গীর সমালোচনা করা উচিত নয়।
— বন্ধুর সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে গিয়ে স্ত্রী বা স্বামীকে বঞ্চিত করা ঠিক না।
— সঙ্গী পছন্দ করেন না, এমন বিষয় তাঁকে দিয়ে করানোর চেষ্টা না করাই ভালো। এতে দাম্পত্য জীবনে তিক্ততার সৃষ্টি হয়।
— দাম্পত্যে ঝামেলা হতে পারে এমন বিষয়গুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।
সারা যাকের মনে করেন, দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি নির্ভর করে ভালোবাসার গভীরতার ওপর। তাই ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে মূল্য দিতে শিখুন সঙ্গীর পছন্দকে, গুরুত্ব দিন তাঁর ভালো লাগার বিষয়গুলোকে। আস্থা ও বিশ্বাস রাখুন তাঁর প্রতি।
ফারহানা আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২১, ২০০৯
Leave a Reply