সন্ধ্যা ৭টা। কাজ শেষে ফিরছিলেন তানিয়া। পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন একজন লোক। একা নাকি? বলেই, পাশ থেকে ধাক্কা। থমকে দাঁড়িয়ে ঘুরে প্রতিবাদ করতেই শুনতে হয়, ‘ঘরে বসে থাকতে পারেন না, বাইরে আসছেন ক্যান’।
প্রতিদিন পথ চলতে গিয়ে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার সব শ্রেণী-পেশার নারী। নারীদের প্রতি এরকম আচরণ পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে ইভটিজিং হিসেবে পরিচিত।
ইভটিজিং নারীদের উত্ত্যক্ত তথা অপদস্থ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইভটিজিংয়ের কারণে মেয়েরা স্বাভাবিক সব সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে প্রথাগত গৃহবধূর ভূমিকায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। ফলে সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাধারণত ১০ থেকে ১৫/১৬ বছর বয়সী স্কুলপড়-য়া মেয়েরাই এর প্রধান শিকার। এমনকি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরাও এ থেকে রেহাই পায় না। শুধু তাই নয়, যে কোনো বয়সী নারীই এর শিকার হয়ে যেতে পারেন যে কোনো মুহূর্তে।
ইভিটিজার বা উত্ত্যক্তকারীরা উত্ত্যক্ত করার কাজটি খুব নিখুঁতভাবেই করে থাকেন মেয়ের বয়সী, মায়ের বয়সী নারীদের সঙ্গে। তারা এ অপরাধটি করেন নানা অভিনব কায়দায়। এক সময় সমাজের বখে যাওয়া একটি ক্ষুদ্র অংশই ইভটিজিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমানে উঠতি বয়সী তরুণ, কিশোর-যুবকরা তো আছেই, মধ্য বয়সীরাও এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
উত্ত্যক্তের কারণে বিভিন্ন সময় প্রাণ দিয়েছে সিমি, রুমি, তৃষা, স্বপ্নারা। গাইবান্ধার ছোট্ট তৃষা বখাটেদের কবল থেকে বাঁচার জন্য পানিতে ঝাঁপ দিয়ে করুণ মৃত্যুর শিকার হয়। ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন নারায়ণগঞ্জের চারুকলার ছাত্রী সিমি। বর্তমানে জেল থেকে বেরিয়ে অপরাধীরা সিমির পরিবারকে দিচ্ছে হুমকি। ওরা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে ইভটিজিং থেকে, যারা বেঁচে আছে, প্রতিনিয়ত তারা শিকার হচ্ছে এই নির্যাতনের। তাই ইভটিজিং নামের এই জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট ও কঠোর আইন তৈরি করার দাবি উঠেছে ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে।
ইভটিজিংয়ের শিকার হয় কারা? প্রতিবেদকের এমনি এক প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘যখন কোনো নারী বাইরে বের হয়ে কোনো কাজে যুক্ত হন, তখন তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রবল মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করতে হয়। সংগ্রাম করতে হয় চোখে দেখা যায় না এমন উপসর্গের সঙ্গে। নতুন যোগ হয়েছে সেলফোন ও ইমেইল। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টিজ করা, ছবি তোলা ও অশালীন কথা শোনানো এখন আরেকটি বড় বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ উত্ত্যক্ত বলতে কাউকে উদ্দেশ্য করে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা, কিছু বলা, পিছু নিয়ে হয়রানি করা, পথরোধ করা, সাড়া না দিলে হুমকি দেয়ার বিষয়গুলো বিবেচিত হয়। ঘরে থেকেও মেয়েরা পরিত্রাণ পাচ্ছে না। একটি মেয়ে যখন শৈশব পার করে কিশোরী হয়, তাকে নিয়ে বাবা-মার শুরু হয় বিড়ম্বনা। তার স্কুল, বাইরে পড়াশোনা করা কিংবা বাড়ির বাইরে একটু বের হওয়ার জন্য নিতে হয় নিরাপত্তার বেড়াজাল।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়-য়া মেয়েদের ওপর মহিলা আইনজীবী সমিতি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৭৫ ভাগ মেয়েই উত্ত্যক্তের শিকার হন।
সূত্র জানায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী শারীরিক মিলন হয়রানি কিংবা শ্লীলতাহানির জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর, নয়তো কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। নারীদের উত্ত্যক্ত করার জন্য
শাস্তির বিধান আছে সর্বোচ্চ মাত্র পাঁচ মাস বা এক বছর কারাদণ্ড কিংবা ২ হাজার টাকা জরিমানা। জরিমানা আদায় না হলে কি করা হবে তার উল্লেখ নেই কোথাও। এই ন্যূনতম শাস্তির বিধান দিয়ে এ ধরনের অপরাধের প্রতিকার কতোটা সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাছাড়া এই আইনগুলোর কথা সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা আইনজীবীরাও অনেকে জানেন না। তাই প্রয়োজন ইভটিজিং সংক্রান্ত একটি সুনির্দিষ্ট ও কঠোর আইন।
জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, জাতীয় কন্যা-শিশু এডভোকেসি ফোরাম এবং সাপ্তাহিক ২০০০-এর যৌথভাবে আয়োজিত ‘উত্ত্যক্তা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আমাদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নারীকে দক্ষ ও যোগ্য মানসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সমাজের সকলকে নীরবতা ভেঙে রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত ও হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। অন্যথায় মেয়ে-শিশুর জীবন বিকাশের জন্য একটি বৈষম্য ও নির্যাতনমুক্ত সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। উত্ত্যক্ততা প্রতিরোধে বখাটেদের এক করে তাদের ভালো কাজে যুক্ত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তারা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-ভারত ও পাকিস্তানে ইভটিজিংয়ের কারণে নারীরা একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং অবারিতভাবে তা বেড়েই চলেছে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে।
অন্যদিকে এশিয়া মহাদেশেরই অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র জাপানে সমস্যাটিকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়ে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে, পুলিশ সাক্ষী বা প্রমাণ পেলে ঘটনাস্থলেই অপরাধীকে শায়েস্তা করে থাকে।
অথচ বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালের ডিএমপি (উগচ) অধ্যাদেশ ও ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিতে এ ব্যাপারে দিননির্দেশনা থাকলেও আইনের প্রয়োগের অভাবে এ ধরনের অপরাধ বেড়েই চলেছে। বাস্তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে সিমি, রুমি, তৃষার মতো মেয়েদের অকালে অযথা প্রাণ হারাতে হবে না, নিশ্চিন্তে পথ চলতে পারবে তানিয়ার মতো কর্মজীবী নারী ও অন্যরা।
এমরানা আহমেদ
সূত্র: দৈনিক ভোরের কাগজ, জুলাই ০৬, ২০০৯
Leave a Reply