অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি
পর্নো সাইটে আসক্ত হচ্ছে কিশোরীরা
যুগের চাহিদা এবং শিক্ষার অনুষঙ্গ হিসেবে অনেক কিশোরীই এখন কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবকই খেয়াল করেন না- তার সন্তানটি কম্পিউটারে ইন্টারনেটে কী কাজ করছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে শুনে হয়তো একদিন তার মেয়েটিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে শারীরিক মিলন সাইটে ঢুকে পড়তে পারে। একদিন-দুদিন করতে করতে তা তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যাবে। অভিভাবকটি যদি সচেতন হন তাহলে এই ঘটনা এড়ানো সম্ভবঃ
রীতা ভৌমিক
কেসস্টাডি-১ : নীলা (আসল নাম নয়) একটি মফস্বল শহর থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আবাসিক ছাত্রাবাস না থাকায় কয়েকজন ছাত্রী মিলে তিন কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়েছে ওরা। কয়েকটা মাস ভালোই কেটেছিল। প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ হবার পর হাতে তেমন কাজ ছিল না। কম্পিউটারে গেমস খেলে, চ্যাটিং করে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে কাটাতে ওরা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। এ সময় ওদের এক রুমমেট জানালো, সে ওদের একটা ভিন্ন বিনোদন দিতে পারে, যদি এ কথা ওরা কাউকে না বলে। কৌতূহলের বশে ওরা সেদিন তা দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করে। সেই রুমমেট ঘরের দরজা বন্ধ করে কম্পিউটার খুলে ইন্টারনেটের পর্নো সাইটে ঢুকে পড়ে। নীলা বলেন, বান্ধবীদের সবার সামনে দেখতে একটু লজ্জা লাগছিল। আবার অজানা এই বিষয়টি দেখে শরীরের ভেতর একটা অনুভূতিও কাজ করছিল। সেই থেকে শুরু। মন ভালো না থাকলেই পর্নো সাইটে ঢুকে পড়তাম। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। সময় পেলেই এখন পর্নো সাইটে বিচরণ করি।
কেসস্টাডি-২ : কয়েকদিন ধরে আশা (ছদ্মনাম) লক্ষ্য করছে তার মেয়ে জয়া ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে। কারো সঙ্গেই নেহাত প্রয়োজন না হলে কথা বলে না। এমনকি প্রাইভেট শিক্ষক পড়াতে এলেও দরজা বন্ধ করে পড়ে। এ নিয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে তেমন ফল না হলেও ইদানীং দরজাটা ভেজানো থাকে। একদিন অনেক রাতে মেয়ের ঘরে আলো দেখে বাতি নিভাতে আশা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজায় টোকা দিতেই বুঝতে পারে দরজা ভেজানো। দরজা খুলে তাকিয়ে দেখে মেয়ে কম্পিউটারের টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। কম্পিউটার অন করা। কম্পিউটারের পর্দায় একজোড়া নারী-পুরুষের অ্যাডাল্ট ছবি। ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আশা বুঝে যায়- তার আদরের কন্যা জয়া ইন্টারনেটে গিয়ে পর্নো সাইটে ঢুকেছিল। এসব দেখতে দেখতে তার ঘুম পেয়ে যাওয়ায় কম্পিউটার বন্ধ করার কথা মাথায় আসেনি। আশা দ্রুত মাউস চালিয়ে কম্পিউটারটি বন্ধ করে দেন।
আশার মতে, একজন উনিশ বছরের মেয়ে যদি ঘরের দরজা বন্ধ করে পর্নো সাইটে বিচরণ করে তাহলে তার ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? এটা ভেবেও ভয় পাচ্ছি, যে মেয়ে অভিভাবকের অগোচরে এসব কাজ করার সাহস পায়, সেতো আরো বড় ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধা করবে না। কতোক্ষণ একটি মেয়েকে তার অভিভাবক চোখে চোখে রাখবে? মেয়ের সঙ্গে খোলাখুলি বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সেই বা কথাটিকে কিভাবে নেবে? অন্যদিকে কম্পিউটারে কাজ করাও নিষেধ করা যাবে না। কারণ এটি তার শিক্ষারই একটি মাধ্যম। প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলে মেয়েটি ভালো ফলাফল করতে পারবে না। অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আনিসুর রহমান জানান, চৌদ্দ থেকে উনিশ বছরের কিশোরীদের মধ্যে অজানা জিনিস সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেশি থাকে। তারা কৌতূহলপ্রিয় হয়। যুগের চাহিদা এবং শিক্ষার অনুষঙ্গ হিসেবে অনেক কিশোরীই এখন কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবকই খেয়াল করেন না- তার সন্তানটি কম্পিউটারে ইন্টারনেটে কী কাজ করছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে শুনে হয়তো একদিন তার মেয়েটিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নো সাইটে ঢুকে পড়তে পারে। একদিন-দুদিন করতে করতে তা তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যাবে। অভিভাবকটি যদি সচেতন হন তাহলে এই ঘটনা এড়ানো সম্ভব। অভিভাবককে মেয়েটিকে কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় নির্দিষ্ট করে দিতে হবে এবং সে সময়ে তিনি সেই কক্ষে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু তার মেয়েটিকে বিষয়টি বুঝতে দেয়া বা সরাসরি বলা যাবে না। কারণ ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেহেতু পর্নো সাইটে ঢোকা যায়, তাহলে দেখা যাবে সে অন্যত্র গিয়ে বা রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তার কৌতূহল মেটাতে পারে। অভিভাবক তার মেয়েটির দিকে একটু সজাগ দৃষ্টি দিলেই মেয়েটি গোপনে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে না। তিনি বলেন, এটি যদি বন্ধ না করা যায় তাহলে এসব কিশোরী ফ্রি শারীরিক মিলনের দিকে ঝুঁকে যাবে এবং তাদের ভেতর উত্তেজনা কাজ করবে। তাদের শারীরিক মিলন করার আগ্রহ বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একটি স্পেশাল উইং পর্নো ওয়েবসাইট তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে এই অপরাধের মাত্রাও কমে যাবে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ মুনসুর আলী সিকদার এ সম্পর্কে বলেন, প্রত্যেক অভিভাবকের কম্পিউটার বিষয়ক প্রাথমিক ধারণা থাকা দরকার। তাহলে তারা বুঝতে পারবেন তাদের সন্তান ইন্টারনেটের কোন ওয়েবসাইট নিয়ে কাজ করছে। এক্ষেত্রে আপত্তিকর বিষয়বস্তুর কোন ওয়েবসাইট ডাউনলোড হতে দেখলেই অভিভাবকরা
তাৎক্ষণিকভাবে সেটা বন্ধ করে দিতে পারবেন।
তিনি আরো বলেন, এখন বাংলাদেশীরাও এ ধরনের ওয়েবসাইট তৈরির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এটাকে কিভাবে বন্ধ করা যায়, এ নিয়ে সরকার এখনো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে কাজ করার ইচ্ছে আমাদের আছে।
সূত্র: দৈনিক ভোরের কাগজ, জুলাই ০৯, ২০০৯
Leave a Reply