‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।
কথাটা যদি চন্দ্র-সূর্যের মতো ধ্রুব সত্যি হয়ে থাকে, তবে কেন নারীরা আজ এতোই অবহেলিত? পদে পদে হয় অপমানিত-লাঞ্ছিত আর নির্যাতিত? পৃথিবীতে মহান স্রষ্টার সৃষ্টি নর এবং নারী উভয়ের প্রচেষ্টার ফলেই তো, বিশ্ব এতো সুন্দর রূপ লাভ করেছেঅ এতো শুধু পুরুষ বা নারীর একার ফসল নয়। পুরুষের যেমন অর্ধেক অবদান রয়েছে নারীরও তেমন অর্ধেক অবদান রয়েছে। একটি পরিবারকে যেমন সুন্দর ও সুখী করে গড়ে তুলতে নারী-পুরুষ দুজনেরই প্রচেষ্টার প্রয়োজন আছে। তেমনি প্রয়োজন আছে সুন্দর, সুখী ও উন্নত দেশ-জাতি-পৃথিবী গড়ে তুলতে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- আমরা নারীরা বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে, কম্পিউটারের যুগে এসেও মান্ধাতা আমলের নারীদের মতো বন্দী জীবনযাপন করি। আমাদের পায়ে এখনো পরে সেই যুগের শৃঙ্খল। আমরা নারীরা যদিও পুরুষদের মতো সব বিষয়ে অবদান রেখে চলেছি, কিন্তু সমাজের বেড়াজাল থেকে কি আমরা মুক্ত হতে পেরেছি? না, তা আমরা পারিনি।
যতোই ভালোভাবে চলো না কেন, সৎভাবে জীবনযাপন করো না কেন- শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দোষ ধরবেই। তার একটি উদাহারণ দিচ্ছি: আমার এক আত্মীয় বিয়ে করে ঘরে বউ এনেছে। বিয়ে বাবদ খাওয়া-দাওয়া, যৌতুক হিসেবে জায়গা-জমি- ফার্নিচার সবই দিয়েছে। যাতে তাদের মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে সুখে থাকে। কিন্তু এতোকিছু দেয়ার পরও মেয়েটি সুখী নয়? তার কারণ বাড়িতে রয়েছে বিবেকহীন দজ্জাল শাশুড়ি, শয়তান ভাসুর-দেবর ও রায়ভাষিণী ননদিনী। এদের বাড়িতে বড় বউ উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া এবং সুন্দরী বলে- সবাই তাকে মাথায় করে রাখে। মেয়েটি ছোট বউ হওয়ায় এবং কর্মঠ, ধার্মিক, মিশুক প্রকৃতির হওয়ায় এরা সবাই তাকে জ্বালাতন করে। বিবেকহীন শাশুড়ি সংসারের যাবতীয় কাজ তাকে দিয়েই করায়। যা তার একার পক্ষে কষ্টসাধ্য।
এ ক্ষেত্রে আমি বলবো- শুধু স্বামী ভালো ব্যবহার করলে হয় না বরং পরিবারের সবার উচিত বউয়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা।
আমরা নারীরা বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে আসি সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে। তাই শ্বশুরবাড়ির লোকদের উচিত- আমাদেরকে তাদের কৃষ্টি, কালচার, পরিবেশের সঙ্গে এডজাস্ট হওয়ার সময় দেয়া। হুট করে একটা অচেনা-অজানা পরিবেশে এসে, সে পরিবেশ মানিয়ে নেয়া সহজ নয়। আমার মতে ঘরে নতুন বউ এনে বউকে তাদের পরিবারের সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া উচিত। যদি সে একবার বুঝতে না পারে, যতোক্ষণ সে না বুঝে ততোক্ষণ তাকে বুঝিয়ে দেয়া উচিত। বুঝিয়ে না দিয়েই যদি বলা হয়- একটা কাজও ঠিকমতো হয় না, এটা করেছো কেন, ওটা করোনি কেন? তবে বউ বেচারি বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে, পেঁচার মতো চেয়ে থাকবে; এতে তার করার কিছুই নেই। যেহেতু আমরা পরিবারের ৩ নারী সদস্য একসঙ্গেই থাকি; সেহেতু আমরা যদি ৩ জনে ৩টি কাজ করে ফেলি- তবে সময় ব্যয় হবে কম এবং কাজও দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। এরকম না করলে একটি মেয়ের পক্ষে সব কাজ একা করা সময়ের ব্যাপার এবং কষ্টসাধ্য হয়।
যে পরিবারে বউকে শাশুড়ি-ভাসুর-দেবর ও ননদ মিলে সব কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়, কাজ করতে একটু দেরি হলে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে; কথায় কথায় মারধর করতে চায়- এদের বিবেক বলে কিছুই নেই। এরা কি একবারও ভেবে দেখে না- শাশুড়িটিও একদিন বউ ছিল? তার মেয়েটিও পরের ঘরের বউ হবে? তার জীবনও যদি এরকম হয় তবে মেয়েটি কি অশান্তিতে থাকবে না? পরিশেষে বলবো- পরের ঘরের মেয়েকে বউ করে এনে শাশুড়ির উচিত তাকে আদর-স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মেয়ের মতো গ্রহণ করা। আর ভাসুর-দেবর-ননদের উচিত তার সঙ্গে বোনের মতো; বন্ধুসুলভ আচরণ করা। তবেই মেয়েটি সবাইকে আপন করে নেবে- সহজভাবে মেনে নেবে।
তাছলিমা সোলতানা
সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম
সূত্র: দৈনিক ভোরের কাগজ, জুলাই ০৯, ২০০৯
Leave a Reply