‘আকাশে উড়িছে বক পাখি, বেদনা আমার তারি সাথি’-এমনি একটা গানের সুর দৃক গ্যালারির আনাচ-কানাচ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মানুষও কেমন যেন চুপচাপ। যে যার মতো ধানমণ্ডির দৃক গ্যালারির দেয়ালে সাঁটানো ছবিগুলো দেখছে। কেউবা মুগ্ধ হয়ে ফ্রেমবন্দী ছবিগুলোকেই আবার ক্যামেরাবন্দী করছে। মনে হয় নিজের হৃদয়ের গহিন ভেতরেই সাঁটাতে চায় সেই ছবিগুলো।
আলোকচিত্রী মোহাম্মদ নঈমের ‘দ্য ফেস অব বাংলা’ শীর্ষক এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলবে ৩ থেকে ১১ জুলাই, প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। এই প্রদর্শনীতে মোট ৪৮টি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে আসা অভিনয়শিল্পী ও আলোকচিত্রী আলী যাকের বলেন, ‘বিষয়বৈচিত্র্য এবং বিষয়ের প্রতি সংবেদনশীল এক শিল্পী নঈম। তাঁর প্রথম প্রদর্শনী আমায় মুগ্ধ করেছে।’
প্রদর্শনীকক্ষে ঢুকতেই বাঁয়ে চোখে পড়ল ‘দুরন্ত শৈশব’ শিরোনামের একটি ছবি। কাদামাখা আধো ন্যাংটো তিনটি শিশুর মুখের মায়াবী হাসি যেন অকৃত্রিম সুখেরই ইঙ্গিত দেয়। আর একটু এগোলেই ‘বেদেপল্লী’। নৌকার কোলেই যাদের জীবন বাঁধা, তারাও তো হাসতে পারে, তাদের জীবনও যে এগিয়ে যায়-তারই যেন বাস্তব রূপ ফুটে উঠেছে এই চিত্রে। এর পরই চোখ যায় ‘হাসি’ ছবিটির দিকে। ছবিটিতে এক বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে হাসছে। মনে হলো যেন পৃথিবীর সব বৃদ্ধের মুখের হাসি একই রকম। ‘পদ্মা’ সিরিজে আছে পদ্মার জেগে ওঠা চরে গরুর গাড়ি, কিশোর-কিশোরীদের খেলাধুলা, কৃষকের ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরা। সবই যেন এই বাংলার বাস্তব চিত্র। ‘বেঁচে থাকা’ ছবিটি যেন একেবারেই ভিন্ন রকম। নদীর মধ্যে নৌকা আর সেই নৌকায় সংসার পেতে বসেছে এক দম্পতি। এ-ঘর পেরিয়ে ও-ঘরে যাই। ওপরে নীল আকাশ আর নিচে সবুজ গাছে দুটি সাদা বক খুনসুটিতে ব্যস্ত। রায়েরবাজার বধ্যভূমির পেছনে জমে থাকা পানিতে অস্ত যাচ্ছে লাল সূর্য আর এরই ফাঁকে কিশোরেরা নাটাই হাতে উন্মাতাল আনন্দে ঘুড়ি ওড়াতে ব্যতিব্যস্ত। এই প্রদর্শনীর সব ছবিই হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো।
আলোকচিত্রী নঈম বলেন, ‘আমাদের দেশের ইতিবাচক দিকগুলো যে কত বৈচিত্র্যময়, তা আমি আমার ছবিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের যে ছবিগুলো প্রদর্শিত হয় বা বাইরে যায়, তার প্রায় সবই অনাহারের, দারিদ্র্যের। কিন্তু আমরা যে হাসতে পারি, আমাদেরও যে সুন্দর সংস্কৃতি আছে, তা আমি এই ছবির মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই। আমার স্বপ্ন মানুষ জানুক, আমরা দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও অকৃত্রিম হাসতে পারি।’
তাঁর এই স্বপ্নের কথাগুলো শুনে আরও একবার ঘুরে-ফিরে দেখি পুরো দৃক গ্যালারির প্রদর্শনীকক্ষ। প্রতিটি ছবিই যেন এই বাংলার রূপের একেকটি কাহিনী বর্ণনা করে। গ্যালারি থেকে বের হতেই দেখি ষাটোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধা ফটকের সামনে সাঁটানো প্রদর্শনীর ছবিটি আপন মনে দেখছেন। হয়তো তিনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন এই ছবির মধ্যে, নয়তো খুঁজে পেয়েছেন সেই ছবির মর্মকথা। একটু পর বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে বৃদ্ধা সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলেন; চোখের আড়াল হলেন নিমিষেই। কিন্তু তাঁর এই না-বলা কথাগুলোই যেন প্রদর্শনীর প্রতিটি ছবির মতো হৃদয়ে দাগ কেটে গেল।
সুজন সুপান্থ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৭, ২০০৯
Leave a Reply