শখের কোনো শেষ কি আছে? মাছধরা, নাচ শেখা, মুদ্রা জমানো, লেখালেখি ইত্যাদি হরেক শখের হাজারটি লিখেও তালিকা শেষ করা যাবে না। দেখা যায় কেউ হয়তো জীবনভরই ডাকটিকিট সংগ্রহ করছে, আবার কারও শখের রকম পাল্টাচ্ছে অহরহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফের এই দুই বছরের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই শখ পাল্টে গেছে পাঁচবার, কারণ কোনো শখই তাঁর বেশি দিন থাকে না। আবার নিতান্ত শখের বশে আবৃত্তি শিখে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাহবুব আহমেদ। এখন মূল পেশার পাশাপাশি তাঁর এ শখের কাজটিতেই তিনি আগ্রহ বোধ করেন না আর। ফলে সবার কাছে তাঁর এ রকম একটি ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছে যে তাঁর শখ থাকলেও তিনি তা বহাল রাখতে অক্ষম। শুধু শখের কাজ কেন, শখের মতো অনেকে চাকরিও বদল করেন প্রায়। আর এ কারণে কাছের মানুষদের কাছ থেকে শুনতে হয় ‘কোনো কিছুতে লেগে থাকতে পারে না’ এমন নানা কথা।
মানসিকতার এমন পরিবর্তন হতে পারে দুটো ক্ষেত্রে, এক· শখের পরিবর্তন, দুই· পেশা পরিবর্তন। দুটো ক্ষেত্রই সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষের শখ কেন স্থায়ী হয় না, এর নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হামিদা আখতার বেগম বলছেন, ‘শখ বা হবি পাল্টে যাওয়া বা এর প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার শখেও নানা পরিবর্তন আসতে পারে। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় মানুষের দর্শনও। তাই জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে একজনের শখ যে একই রকম থাকবে, এমন কোনো কথা নেই। আবার সারা জীবনে কোনো মানুষের একটি নির্দিষ্ট শখই থেকে যায়, এমনটিও কিন্তু ঢের দেখা যায়।’
শখ পাল্টে যাওয়াটা তাই কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো কারও ঘন ঘন শখ বদল হলে পরিবার-পরিজনের কাছে সেটা তার চরিত্রের নেতিবাচক দিক হিসেবে গণ্য হওয়াটা। কেউ হয়তো শখ করে কিছুদিন গান শিখল, এরপর মন চাইলে শিখতে চলল তবলা, সেটা বাদ দিয়ে শখ হলো ফটোগ্রাফি শেখার-হুবহু এমনটি না হলেও বাস্তবে এ রকম উদাহরণ পাওয়া যায় ভূরি ভূরি। এ ধরনের ব্যক্তিরা কোনো শখের কাজ বেশি দিন ধরে করতে পারেন না দেখা যায়। তখনই ‘কোনোটাই না করতে পারলে জীবনে কী করবে’ এহেন ভাবনায়, বিশেষ করে মা-বাবারা অস্থির হন এবং ওই ব্যক্তিকেও জর্জরিত করেন এ প্রশ্নবাণে। এ প্রসঙ্গে হামিদা আখতার বেগম মনে করেন, শখ বা হবি হলো সেই কাজ, যা মানুষ নিতান্তই মনের আনন্দ পাওয়ার জন্য করে। তাই শখের কাজের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলা মানে সে কাজে আর সেভাবে তৃপ্তি না পাওয়া। অনেক সময় একটা কাজে আদৃত না হলে, স্বীকৃতি, প্রশংসা ইত্যাদি না পেলে যত ভালোবাসার কাজই হোক না কেন, এতে অনীহা চলে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনো শখে তাই আগ্রহ হারিয়ে ফেললে কাজটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করে লাভ নেই। বরং এর প্রতি তাকে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। আবার অনেকে আছে বেশ খেয়ালি, যেটা ‘সৃষ্টিশীল’ মানুষদের মধ্যে দেখা যায়, তাদের কিছু করার শখ প্রায়ই পরিবর্তন হতে পারে। এটা তাদের চারিত্রিক দিক বটে, তবে চারিত্রিক দোষ কিন্তু অবশ্যই নয়।
শখ স্থায়ী না হওয়া এবং কোনো কিছুতে লেগে না থাকা ভিন্ন ব্যাপার। হামিদা আখতার বললেন, ‘কারও শখ পাল্টাতে পারে যেকোনো কারণে, কিন্তু এ রকম হলেই সে জীবনের অন্য কোনো কাজে মনোযোগী ও স্থির হতে পারবে না, এমন কোনো যুক্তিসংগত বিষয় সম্পর্ক দুটোর মধ্যে স্থাপন করা যাবে না।’
তবে যারা নির্দিষ্ট কোনো চাকরি বা ব্যবসায় স্থির হতে পারে না, তাদের নিয়ে কিছুটা চিন্তার বিষয় আছে। এ ক্ষেত্রে কোনোটাতেই লেগে থাকতে না পারার খোঁটাটা তাদের শুনতে হয় বেশি। কিন্তু এ রকম ব্যক্তিদেরই স্বজনদের সহযোগিতাটা খুব বেশি প্রয়োজন। তাদের এমন আচরণের কারণটি কী, তা তাদের পরিবারকে বুঝতে হবে। নিজেদের মতো করে বোঝাতে গেলে বা বারবার খোঁটা দিলে ফল হতে পারে উল্টো, বরং কোন মানসিকতার দরুন তারা এমনটি করছে, তা বুঝতে হবে আগে। এ বিষয়ে হামিদা আখতারের পরামর্শ হলো, ‘পেশাগত অস্থিরতা যদি বেশি হয়, তখন এর সমাধানের জন্য মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য গ্রহণ করা যেতে পারে।’
শখ হতে পারে কোনো সৃজনশীল কাজ, কোনো কিছু শেখা, হতে পারে ভ্রমণ বা কিছু সংগ্রহ করার নেশা। যেটাই হোক, আর যতই বদলাক, শখ বা হবিকে তাই সব সময় প্রেরণা দেওয়া উচিত। বারবার কারও শখের রকমফের হলে মোটেই চিন্তার কিছু নেই। বরং ছোটবেলা থেকেই কাউকে তার শখের প্রতি উৎসাহিত করতে পারলে তাকে সে বিষয়ে আরও একাগ্র করে তোলা অবশ্যই সম্ভব।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ৩০, ২০০৯
Leave a Reply