কর্মব্যস্ত এ নগরে ইট-কাঠের ঠাস বুনোটের ভিড়ে ব্যস্ত থাকতে হয় প্রতিটি মানুষকে। ভোরের সূর্যের আলোকচ্ছটা ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নারী-পুরুষ তথা প্রতিটি মানুষের ব্যস্ততা। আর এ ব্যস্ততার ভিড়েই মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন আসে। আর এ পরিবর্তন তৈরি করে নতুন নতুন সমস্যার। এ সমস্যা সমাধানের পথ তাই নিজেদের খুঁজে নিতে হয়।
আমাদের সমাজে এমন অনেক মায়েরই সুপ্ত এ মনোভাবকে আঁচ করতে পেরে তাঁর শিশুটির নিরাপদ ও আনন্দঘন পরিবেশে সুন্দর মানসিক বিকাশে গড়ে ওঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি শিশুযত্ন কেন্দ্র ও প্রি-স্কুল। এ মায়েদের প্রয়োজনে আমাদের আজকের এ আয়োজন।
ছায়ানীড় প্রি-স্কুল ও শিশুযত্ন কেন্দ্র
অধ্যাপক ড· নুরুন্নাহার ফয়জুন্নেসার উদ্যোগে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সহায়তায় ১৯৮৬ সালের ২ অক্টোবর গড়ে উঠেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের শিশুদের ব্যাপারে প্রাধান্য দিলেও বাইরের কর্মজীবীদের শিশুদেরও রাখার ব্যবস্থা আছে। এখানে ৬৫ জন শিশু রয়েছে। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের শনি থেকে বুধবার সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা এবং বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সাধারণত যেসব শিশুর বয়স আড়াই থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত তাদের এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয়। চারজন শিক্ষক ও তিনজন বেবিসিটার শিশুদের সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করে থাকেন। এ ছাড়া রয়েছেন খণ্ডকালীন গানের শিক্ষক। শিশুদের খেলা, বিভিন্ন বিষয় শেখানোর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে সু-অভ্যাস গঠন, আনন্দ দেওয়া, সামাজিক বিকাশ, নিরাপত্তা, আত্মপ্রকাশ করা-এসব বিষয়ে জাগ্রত করা হয়। চার-পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের প্রি-স্কুল শিক্ষা দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত কারও শিশু হলে তার মাসিক ফি জুলাই, ২০০৯ থেকে ৬০০ টাকা আর বাইরের কর্মজীবীদের শিশুর মাসিক ফি ১০০০ টাকা, সেশন ফি ৫০০ টাকা এবং ভর্তি ফি বাবদ ৮০০ টাকা জমা দিতে হবে।
পিক্সিল্যান্ড প্লে-গ্রুপ প্রি-স্কুল
এটা কোনো শিশুযত্ন কেন্দ্র নয়, প্রি-স্কুলের ধারণায় নির্মিত এ প্রতিষ্ঠান ১৯৮৫ সালের ৫ জুন কার্যক্রম শুরু করে। সাধারণত এক বছর বয়স থেকে তিন বছর পর্যন্ত শিশু ভর্তি করা হয়। এখানে ৬০ জন শিশুর দেখভাল করার জন্য রয়েছেন ১৪ জন শিক্ষক ও পাঁচজন সহকারী। শিশুদের স্বাবলম্বী করে তোলা, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, সব শিশুর সঙ্গে মেশার ফলে সুন্দর মানসিক বিকাশ হওয়া-এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই গড়ে উঠেছে এ প্রতিষ্ঠান। কার্টুন দেখে একটা শিশুর কথা বলার চাহিদা কমে যায়, কিন্তু সমাজে বাস করতে হলে তাকে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, কথা বলতে হবে, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা, স্কুলে যাওয়ার আগে তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করে তৈরি করে দিচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান। জানান এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মালিহা কুদ্দুস। শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে। এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে সার্বিক খরচ ১০ হাজার টাকার ওপর পড়বে। বিভিন্ন ধরনের পাজেল এবং বই পড়ার মধ্য দিয়ে শিশুদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করে প্রতিষ্ঠানটি।
চাঁদের ভুবন ডে কেয়ার ও প্রি-স্কুল
আপনার চাঁদসোনাকে সুন্দর ও আনন্দঘন পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য আপনারই সহায়তায় খালেদা আখতার ও সিতারা আখতারের উদ্যোগে ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পাঁচজন শিক্ষক ও তিনজন সহকারীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ২০ জন শিশুর দেখভাল করছে এ প্রতিষ্ঠান। শুধু শিশুর পরিচর্যা নয়, এর পাশাপাশি শিশুর স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি, স্কুল থেকে নিয়ে আসা, বাড়ির পড়া তৈরি করা, গান শেখানো, ছবি আঁকা, রং করা প্রভৃতি বিষয়ে শিশুদের শেখানো হয় এ প্রতিষ্ঠানে। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে।
তবে শনিবার সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত খোলা থাকে। কমপক্ষে এক থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের ভর্তি করা হয়ে থাকে। তবে কোনো মা যদি তাঁর ১২ বছরের মেয়েকে বাসায় একা রাখতে নিরাপদ বোধ না করেন, সে ক্ষেত্রে শুধু মেয়েদের ভর্তি করানো যেতে পারে। এতে নিয়মিত শিশুদের ভর্তি এবং সেশন ফি ৭০০০ টাকা এবং মাসিক ফি ২০০০ টাকা (তিন বছরের ওপর) এবং ২৫০০ টাকা (তিন বছরের নিচে শিশুর জন্য)। তবে অনিয়মিত শিশু সপ্তাহে যেকোনো এক দিন বা কয়েক ঘণ্টার জন্য রাখতে চাইলে ২০০০ টাকা দিয়ে রেজিস্টার্ড হতে হবে এবং প্রতিদিনের জন্য ফি ২০০ টাকা এবং প্রতি ঘণ্টার জন্য ফি ৫০ টাকা করে দিতে হয়। শিশুর দেখভাল, শেখানো এসব বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিবছরই পিকনিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যার মাধ্যমে শিশুদের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। শিশুর মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজন ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানে অন্য কাউকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
অ্যাঞ্জেল ওয়ার্ল্ড
কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের নিরাপদে রাখার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সামাজিক ও মানসিক বিকাশ গঠনে এ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে ২০০৪ সাল থেকে। সাধারণত এক থেকে ১০-১২ বছরের শিশুদের সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন দুজন শিক্ষক ও দুজন সহকারী রয়েছেন। ১৫-২০ জন শিশুর আসন রয়েছে এখানে। শিশুদের বিভিন্ন বিষয় শেখানোর পাশাপাশি সপ্তাহে দুই দিন গান ও ছবি আঁকা শেখানো হয়। যেসব শিশু স্কুলে যায় না তাদের প্রি-স্কুল শিক্ষা দেওয়া হয়। আর যারা স্কুলে যায় তাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসা হয় এবং হোমওয়ার্ক করানোর কাজে সহযোগিতা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ফি ৩৫০০ টাকা এবং মাসিক ফি ২৮০০ টাকা। শিশুদের মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিনোদনমূলক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
লাপেতি শিশুযত্ন কেন্দ্র
এখানে ১৪ জন শিশু রয়েছে, যাদের দেখভাল করার জন্য রয়েছেন পাঁচজন শিক্ষক ও দুজন মেইড। এসব শিশুর বয়স চার মাস থেকে আট বছর। সার্বক্ষণিক হলে ভর্তি ফি ৫০০০ টাকা সেবার জন্য, মাসিক ফি ৫০০০ টাকা। আধাবেলা হলে মাসিক ফি ৪০০০, আর সপ্তাহে যেকোনো এক দিনের জন্য শিশুকে এখানে রাখলে ফি ৬০০ টাকা (ভ্যাট ছাড়া)। আর ঘণ্টার জন্য রেখে গেলে প্রতি ঘণ্টার ফি ২০০ টাকা (ভ্যাট ছাড়া) দিতে হবে। শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল পৌনে আটটা থেকে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা পর্যন্ত ফুলটাইম শিশুদের, আর দিনে যেকোনো সময় পাঁচ ঘণ্টার জন্য হাফটাইম শিশুদের রাখা হয়। শিশুদের বিভিন্ন খেলার পাশাপাশি রয়েছে ট্রেজার হান্ট, গল্পের বই, ছড়া, গান শেখা ইত্যাদি। যারা স্কুলে যায় তাদের জন্য রয়েছে প্রিরাইটিং স্কিল ব্যবস্থা। প্রথম দিকে অনেক শিশু আসে, যারা সবার সঙ্গে মিশতে চায় না, তাদের জন্য রয়েছে টিভির ব্যবস্থা। পরে অবশ্য ঠিক হয়ে যায়। খুব কমই এ রকম হয়ে থাকে।
এসব শিশুযত্ন কেন্দ্র ও প্রি-স্কুলের ব্যবস্থায় এরা কখনো শিশুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না, শিশুদের তাদের মা-বাবা বা অভিভাবকেরা কাউকে পরিচিত করিয়ে দিলে তার কাছে দেওয়া হয়। শিশুদের খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানোর কাজও স্বতঃস্কূর্তভাবে এসব প্রতিষ্ঠান করে থাকে। সার্বক্ষণিক সুবিধার জন্য রয়েছে ফোনের ব্যবস্থা।
তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, আপনার শিশুকে যে শিশুযত্ন কেন্দ্রে রাখবেন সেটা তার জন্য নিরাপদ কি না, এর পরিবেশ এবং সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে নিশ্চিত হয়ে তারপর রাখবেন।
জেনে নিন
ঠিকানাঃ ছায়ানীড় প্রি-স্কুল ও শিশুযত্ন কেন্দ্র, আইইআর ভবন (২ নম্বর কক্ষ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। ফোনঃ ৯৬৬১৯২০, এক্স-৪৬৯৬। মোবা-০১৮১৬৭১৯২২৩।
ঠিকানাঃ পিক্সিল্যান্ড প্লে-গ্রুপ প্রি-স্কুল, বাড়ি-৪ (মোবাইল জোনের পাশে, রোড-৪৩, গুলশান-২, ঢাকা। ফোনঃ ০১৭১৩০০২০০৬।
চাঁদের ভুবন ডে কেয়ার ও প্রি-স্কুল, ৬/৯ ব্লক-ডি, লালমাটিয়া, ঢাকা। ফোনঃ ৯১২৭৯৪৬, ০১৭১১৫৩৪৯৩০, ০১৭১৫১৩০৭৮০।
অ্যাঞ্জেল ওয়ার্ল্ড ডে কেয়ার ও কালচারাল সেন্টার, ৬/১০ ব্লক-ই, লালমাটিয়া, ঢাকা। ফোনঃ ৯১১৭২৮৬, ০১৭১১৬১৮০১০, ০১৮১৯২১৪৮১২।
লাপেতি চাইল্ড কেয়ার সেন্টার, বাড়ি-২ই, রোড-২৯, গুলশান-১, ঢাকা। ফোনঃ ০১৭১৫৭৬৯৮৯০।
নাঈমা আমিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ৩০, ২০০৯
Leave a Reply