আষাঢ় আসতে তখনো কয়েক দিন বাকি। উত্তরবঙ্গ চাঁপাইনবাবগঞ্জের আকাশে কোনো মেঘ নেই, এক ফোঁটা বৃষ্টিও নেই। কাশিমপুর গ্রামে ঢুকে মহানন্দার পাড় বেয়ে হেঁটে চলেছি। মহানন্দার বুকেও পানি নেই, মঝেমধ্যেই জেগে উঠেছে বালির চরা। গ্রী্নেরও পর আসবে বর্ষা, প্রকৃতির সুধারসে সিক্ত হবে বসুন্ধরা। তখন নিশ্চয়ই কেটে যাবে এই খরতাপ আর মহানন্দার বুকও ভরে উঠবে কানায় কানায়। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ আটকে গেল সে গ্রামেরই এক বিশাল আকৃতির কদমগাছে। গ্রী্নেও প্রখর রোদ আর বালি-ওড়া বাতাসে দুলছে অজস্র কদম ফুল। কদম কি তাহলে গ্রী্নের ফুল? বাদলের ধারা না নামতেই যেসব কদম ফুটেছে, সেগুলোর কাছে গেলাম। কদম ফুটেছে ঠিকই, কিন্তু বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলটা যেমন স্মিগ্ধ, সেই স্মিগ্ধতা নেই এই কদমগুলোর। গোল বলটার মধ্যে কালচে রং ধরেছে। অনেকটা পচনের মতো। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রকৃতিতেই তো সবার আগে পড়ে। কদমের আর দোষ কী। এর পরও বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। আষাঢ় এল। কিন্তু বৃষ্টি এল না। কদমগুলো বিমর্ষ হয়ে জলতেষ্টায় শুকিয়ে যেতে শুরু করল। বর্ষার সঙ্গে কদমের মিতালি আর দেখা হলো না। অবশেষে ফিরে এলাম ঢাকায়।
ঢাকায়ও বর্ষাকালের বৃষ্টি নেই। একটু-আধটু মেঘ আছে। হয়তো এরই প্রভাবে নগরের উদ্যান ও গাছগুলোতে ফুটতে শুরু করেছে বর্ষার ফুল। ঢাকায় ফিরে আষাঢ়ের প্রথমেই হানা দিলাম বৃক্ষমেলায়। শত-সহস্র গাছের ভেতর খুঁজতে শুরু করলাম বাদলের ফুল। বিভিন্ন নার্সারিতে ফুটে আছে তারার মতো সাদা রঙের মালতীলতা ফুল। হালকা মিষ্টি সৌরভ, রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে তা কিছুটা টের পাওয়া গেল। বড় খোঁপার মতো থোকা ধরে ফুটে আছে হাইড্রেনজিয়া। সাদা, ঘিয়ে বা হালকা গোলাপি, কোনোটাই কম সুন্দর নয়। কদমের মতো বড় বড় পুরু ও নরম সবুজ পাতার ভিড়ে কী সুন্দরই না লাগছে হাইড্রেনজিয়াগুলোকে। টব বা বাগানমাতানো বর্ষার এমন ছায়াবিলাসী ফুল খুব কমই আছে। ছোট ছোট প্যাকেটে লাগানো গাছে ফুটে আছে গমফ্রেনা। সাদা ও ম্যাজেন্টা রঙের ছোট ছোট গোলাকার ফুলগুলোকে আমরা বোতাম ফুল নামেই জানি। পরদিন সকালে দেখলাম, আসাদ গেটের আরবরি কালচারে ম্যাটের মতো লাগানো অজস্র গাছে সেসব ফুল ফুটে আলো করে রেখেছে, সেখানে আরও চোখে পড়ল মোরগঝুঁটি, দোপাটি, ইয়েলো কসমস, সন্ধ্যামণি, টিথোনিয়া, টোরেনিয়া, জিনিয়া, কলাবতী, বেলি ইত্যাদি ফুলকে। বর্ষায় ফোটা ভাদ্রাও চোখে পড়ল মোহাম্মদপুরে সেন্ট যোসেফ স্কুলের প্রাচীরে। গ্রী্নে ফোটা টগর, গন্ধরাজ, বাগানবিলাস, জুঁই, শ্বেতরঙ্গন-এগুলোও বর্ষায় দিব্যি ফুটে যাচ্ছে। সারা বছরই দু-চারটা অলকানন্দা বা অ্যালামন্ডা ফুটলেও বাদল দিনে ওর স্কুরণটা চোখে পড়ার মতো। যেমন স্মিগ্ধ রূপ, তেমন বড় বড় ফুল। ফোটেও গাছ ভরে। তেমনি ফোটে সন্ধ্যামণি। এর ফুল সন্ধ্যাবেলায় ফোটে বলেই নাম সন্ধ্যামণি। তবে ঠিক সন্ধ্যা নয়, বিকেল থেকেই সন্ধ্যামণি পাপড়ি মেলতে শুরু করে। এ জন্য সন্ধ্যামণির ইংরেজি নাম ‘ফোর-ও-ক্লক ফ্লাওয়ার’। সন্ধ্যামণির ফুল দেখতে কলমির মতো। তবে কলমির চেয়ে অনেক ছোট। ফুলের রং লাল, ম্যাজেন্টা, সাদা, হলুদ, কমলা, এমনকি মিশ্র বর্ণও হয়। ফুলে মৃদু সুগন্ধ আছে। ফুলের আকর্ষণ ততটা না থাকলেও সন্ধ্যায় যখন বেশির ভাগ গাছের ফুল শুকিয়ে যায়, তখন সন্ধ্যামণির আদর বাড়ে। ফুলও ফোটে গাছ ঝেঁপে। ফুলে ভরা ঝোঁপালো গাছটি তখন গোধূলি আলোয় অন্য রকম লাগে। ঠিকই এ রকমই এক গোধূলি আলোয় বাসন্তীরঙা সন্ধ্যামণি আমাকে মুগ্ধ করেছিল লালমনিরহাটের এক শালবনে। অনেক গাছ, অনেক ফুল। কেউ লাগায়নি। এমনিতেই জঙ্গলে হয়েছিল। বর্ষার আর এক সুগন্ধি ফুল রজনীগন্ধা। বছরের অন্য সময় দু-একটা পাওয়া গেলেও ওর আসল ফোটার সময় হলো বর্ষার দিন। রজনীগন্ধার মতো আরও কিছু কন্দজ ফুল আছে, যেগুলো বর্ষায় ফোটে। ঘাসফুল বা ডে লিলি এবং স্পাইডার লিলি এগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এবার কিন্তু দিগন্ত কালো করে মেঘ নেমে এল। আকাশের বুকে থই থই জল। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় ডোবা-নালা সব জলে ভরে উঠেছে। ঠিক এমন এক বাদলা দিনে হাজির হলাম মৌলভীবাজারে। সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করলাম বর্ষায় ফোটা নীলপদ্মকে! পৌরাণিকের রামচন্দ্র এক শ আটটি নীলপদ্মের খোঁজ কোথায় পেয়েছিলেন জানি না, কিন্তু আমাদের দেশের জলে-ডোবায় যে এমন শত শত নীলপদ্ম ফুটে থাকতে পারে, তা না দেখলে চোখকে বিশ্বাস হতো না। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ওটা নীলপদ্ম হলেও আসলে সে নীল শালুক বা নীল শাপলা। বর্ষা শুরু হয়েছে। আর ফুটতে শুরু করেছে শাপলা-শালুক-পদ্মরা। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় সীমান্তগাঁও মনতলা যেতে জয়নগরের বিলে হঠাৎ চোখে পড়ল এক অপূর্ব সুন্দর ফুল ফুটেছে সেই বিলের জলে। হেলাঞ্চি ঝোঁপের মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে মাথা উঁচু করে। নীল রঙের এমন ফুল সচরাচর চোখে পড়ে না। গ্রামবাসী বলল নীলপদ্ম। কিন্তু না, ওটা শালুক, আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। রংটা আকাশের মতো নীল আর ফুলের আকারও বড়। বাদল দিনে সাদা, গোলাপি, লাল প্রভৃতি রঙের শালুক প্রায় সব জায়গাতেই চোখে পড়ে। মাঝেমধ্যে দেখা যায় বেগুনি শালুক। খুলনার দাকোপ উপজেলায় এক বিলে কয়েক বছর আগে তা দেখেছিলামও। কিন্তু নীল শালুকের দেখা খুব কমই মেলে। পৌরাণিক সাহিত্যে একে নীলকমল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পদ্মের সঙ্গে এর অনেক মিল। তবে নীল রঙের কোনো পদ্ম নেই, কখনো ছিল না। বর্ষা শেষ হতে না হতেই শুরু হয় পদ্ম ফোটা। মৌলভীবাজার থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে কুলাউড়ার সমাই টিলার পাদদেশে এক পদ্মপুকুরে দেখলাম দলে দলে ফুটছে শ্বেতপদ্ম। সাদা দুধের মতো ওর পাপড়ির রং। সাধারণত গোলাপি রঙের পদ্মই বেশি। গাজীপুরের বিলগুলোতে গোলাপি পদ্মের মাতামাতি। এ দেশের পুকুর ও বিল-ঝিলে সাদা রঙের পদ্মও মাঝেমধ্যে দেখা যায়। তবে দিন দিনই পদ্মরা কমে যাচ্ছে। বর্ষা মানে জল, জল মানেই জলজ ফুলের মেলা। তাই বর্ষার দিনে বিস্তীর্ণ জলের শান্ত চাতালজুড়ে যখন ফুটে ওঠে সাদা রঙের অজস্র চাঁদমালা ফুল, খুদে সেসব ফুলের বাহার মুগ্ধ করে। হয়তো কোনো দিন কোনো মধুকর ডিঙা বেয়ে এসব ফুলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আরও বেশি মুগ্ধ হয়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ৩০, ২০০৯
Leave a Reply