মাদক-এক ভয়াবহ জগতের নাম। হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, আফিম, চরস, প্যাথেডিন, ভাং-কতই না চেহারা এই বহুরূপীর। এগুলোই সব নয়, এ দেশে মাদকের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ইয়াবা। বাংলাদেশে দিন দিন বাড়তে থাকা মাদকাসক্তের সংখ্যা বেসরকারি হিসাবমতে এখন প্রায় ৭০ লাখ, যার বড় অংশ হলো যুবসমাজ। আর ইয়াবা জনপ্রিয় হয়েছিল মূলত তরুণদের কাছেই। স্মায়ুকে উত্তেজিত বা প্রশান্ত করে কিংবা অবাস্তব দৃশ্যাবলির (হ্যালুসিনেশন) মাধ্যমে মাদক নানা রকম অনুভূতি দেয়। এই অনুভূতিটুকু ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু নেশার কুফল দীর্ঘস্থায়ী, যার পরিণতি কখনো বা মৃত্যু। তবে কেন এই মিথ্যা ভালো লাগার হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া? কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, স্রেফ কৌতূহলবশত, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, প্রেমে ব্যর্থতা বা পারিবারিক হতাশাজনিত কারণে অসুখী মন সুখ খুঁজে নিতে সমর্পিত হচ্ছে মাদকের কাছে। এত হতাশার জড়টাই বা কোথায়? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ খালেদা বেগম বলেন, ‘রোগের ইতিহাসে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেখানে পারিবারিক বাঁধন খুব আলগা, সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মায়ের কোনো দৃঢ় বন্ধন নেই, সেসব পরিবারে সন্তানদের আসক্ত হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে বেশি। সন্তানদের নেশা থেকে দূরে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো বাবা-মায়ের।’
হ্যাঁ, নিরাময়ের চেয়ে যেহেতু প্রতিরোধই ভালো, তাই মাদকের আগ্রাসন প্রতিহত করার কাজটি শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই। বাবা-মায়ের করণীয় অনেক কিছুই আছে। আপনি যদি হয়ে থাকেন কোনো সন্তানের বাবা কিংবা মা, তাহলে আপনার প্রথম কাজটি হলো সন্তানের প্রতি মনোযোগী হওয়া, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। সুসম্পর্ক বলতে এমন সহজ সম্পর্ক যাতে সন্তান তার কথাগুলো আপনাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারে। বোঝাতে যাওয়া নয়, বরং সন্তানের সমস্যা, রাগ, চাপা ক্ষোভ ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা করুন। যেকোনো পরিস্থিতিতে আপনারা তার পাশে আছেন, এমন বিশ্বাস তৈরি করুন তার মনে। এতে সন্তান কোনো কারণে হতাশা বা সমস্যাগ্রস্ত হলে নেশায় নির্ভরশীল না হয়ে ভরসা করবে আপনাকেই। কেউ যদি কৌতূহলবশত মাদকের দিকে আকৃষ্ট হয়েও যায়, তাহলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলার সুযোগ থাকলে তার পক্ষে তার এ সমস্যার কথা বাবা-মাকে জানানো সহজ হবে এবং বাবা-মাও দ্রুত এর নিরাময়ের দিকে এগোতে পারবেন।
সন্তানের কাছাকাছি আসার প্রধান উপায় হলো তাদের সময় দেওয়া। কারণ একটি সন্তানের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তার পিতা-মাতাকে। এই মৌলিক প্রয়োজন বিত্ত বা পণ্যে মেটার নয়, বরং চাই ভালোবাসা, ভরসা, সঙ্গ ও সুশিক্ষা। মা-বাবার কাছ থেকে মানসিক চাহিদাটুকু পূরণ না হলে সন্তান হতাশ হয়ে পড়তে পারে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে, আশ্রয় খুঁজে নিতে পারে নেশায়। তাই বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের মানসিক সংযোগ স্থাপন খুব জরুরি। এই কর্মমুখী যুগে প্রতিদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের দেখাই কবার হয়, তা হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে খালেদা বেগম বলেন, ‘এ রকম অনেক দেখা যায় যে সারা দিনের পর ক্লান্ত শরীরে সঙ্গ দেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় ঘরে ফেরার সময় কেনা খাবার, খেলনা তুলে দিয়ে বাচ্চাকে অন্যভাবে ব্যস্ত রাখছেন অফিসফেরত বাবা-মা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব কখনোই চিপসের প্যাকেট বা চকলেট দিয়ে প্রতিস্থাপিত হওয়ার নয়।’
শুধু মা-বাবা কেন, সন্তানদেরও কি ফুরসত আছে? সকালে ক্লাস তো বিকেলে কোচিং, তারপর ইন্টারনেট আর আড্ডা তো আছেই। তার পরও সময়ের অভাবে দুই পক্ষের মধ্যে সৃষ্ট শূন্যস্থান পূরণের উপায় যে নেই, তা নয়। তার জন্য অবশ্য সচেতন হতে মা-বাবাকেই। সারা দিনে এক বেলা অবশ্যই সবাই একসঙ্গে খেতে বসুন। খাবার টেবিলই না হয় হোক আপনাদের যোগাযোগ স্থাপনের কেন্দ্র। কর্মজীবী মায়েরা ছুটির দিন সন্তানকে আলাদা করে সময় দেওয়ার চেষ্টা করুন। যারা একমাত্র সন্তান, তাদের একটু বেশি সঙ্গ দেওয়া খুব দরকার। সপ্তাহে একবার পরিবারের সবাই মিলে বেড়িয়ে আসুন, তাতে আপনার সন্তান আরও পরিবারমুখী হয়ে উঠবে। বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই মাদকের ভয়াবহতা ও কুফল সম্পর্কে জানিয়ে দিতে হবে সন্তানদের। ধর্মীয় অনুশাসনে লালন করুন তাদের, কারণ ধর্মীয় চিন্তা মানুষের বিবেককে জাগ্রত ও দৃঢ় করে। এ কালের ছেলেমেয়েদের অন্যতম মূল বিনোদন হলো টেলিভিশন। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষণীয় চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে বুনে দিতে পারেন সুস্থ সংস্কৃতির বীজ, সামাজিক মূল্যবোধ ও ভালো-খারাপের ধারণা। এবং হ্যাঁ, কখনোই সন্তানের সামনে নিজেরা ঝগড়াঝাঁটিতে লিপ্ত হবেন না। বাবা-মায়ের মধ্যে খারাপ সম্পর্ক সন্তানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এবং অনেকেই নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ছোট থেকেই সন্তানদের ঘরের কাজ ও তার নিজের কাজ নিজে করতে দিন। কাজ করতে গেলেই ভুল বা সমস্যা হবেই, সেটা সমাধানেরও একটা প্রবণতা তৈরি হবে যা পরবর্তী সময়ে তাকে যেকোনো চাপ মোকাবিলার যোগ্য করে তুলবে। তাতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে ওঠায় মানসিক চাপে পড়ে মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।
অনেকেই মনে করেন। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলে তারা বাবা-মাকে মান্য করবে না। আবার অনেকে সন্তানকে অতিরিক্ত চোখে চোখে রাখেন। আর এতে ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’র তত্ত্ব মোতাবেক সন্তান চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শাসন অবশ্যই করতে হবে, তবে সে শাসন যাতে না হয় দুঃশাসন। সন্তানের গতিবিধি ও তার বন্ধুবৃত্ত অবশ্যই নজরে রাখা প্রয়োজন। যদি কখনো তার কুসঙ্গ নিয়ন্ত্রণের দরকার হয়, তখন দুঃশাসনে ফল হবে উল্টো। বরং তার সঙ্গে আপনার সহজ সম্পর্ক থাকলে সে বুঝবে যে আপনি তার ভালো-মন্দ বোঝেন ও তখন তাকে বোঝানো সহজ হবে যে তার কোন বন্ধুটি কেন খারাপ। নেশার শুরু হতে পারে কোনো ওষুধ দিয়ে। ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্যই আসলে ইয়াবা, ফেনসিডিলের জন্ম হয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিত ও অপব্যবহার একে নেশাদ্রব্যে পরিণত করেছে। তাই খেয়াল রাখুন সন্তান অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, যেমন ঘুমের ওষুধ সেবন করছে কি না।
মা-বাবার দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়। প্রথম যখন বুঝতে পারবেন যে সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে, নিজের আবেগকে সংবরণ করে তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। মনে রাখবেন, ওই মুহূর্তে আপনার চেয়ে আপনার সন্তান বেশি কষ্টে আছে। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর মাদকের জগতে আর ফিরবে না, সবার কাছে এ বিশ্বাসটুকু অর্জন করতে অনেক সময় একজন মাদকাসক্তকে ভীষণ বেগ পেতে হয় পারিবারিক অসহযোগিতার কারণে। সেই সময়টায় হতাশ হয়ে সে আবার নেশার কবলে পড়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হামিদা আখতার বেগম বলেন, ‘পরিবারকেই বেশি দরকার সেই মুহূর্তে। আমি একা নই-এ বিশ্বাস তাকে শক্তি জোগাবে। এ সময় পরিবারের উচিত তাকে বিশেষজ্ঞের সাহায্য দেওয়া ও গ্রুপ থেরাপি করানো, যেখান থেকে অন্য মাদকাসক্তি-ফেরত মানুষের ভোগান্তি ও উত্তরণের কথা শুনে সে নতুন করে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে।’ মনে রাখবেন, পরিবারই সবচেয়ে বড় আশ্রয়, শক্তি ও ভরসা হয়ে উঠতে পারলে, মাদক কেন, কোনো বিপথেই পা বাড়াবে না আপনার সন্তান।
ফারাহ শাম্মা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ৩০, ২০০৯
Leave a Reply