আধুনিকতার নামে মেয়েরা যদি নিজেদের চিরন্তন মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাহলে সে এককেন্দ্রিক ব্যক্তি হতে পারে কিন্তু তার মানসিক বোধের মর্যাদা স্নিগ্ধ হবে না। সমাজের কাছে এধরনের নারী তার প্রকৃত মর্যদাকে বড় করতে পারবে না।
প্রচলিত রক্ষণশীল জ্ঞান এবং সমষ্টির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নারী আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। নিজের ব্যক্তিত্বকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রকাশ করেছে। সময়ের অসচেতনতা তা যেন খর্ব না করে।
অপলা, সকাল বিকেল তার কেবলই ছুটে চলা। নারী আন্দোলন, অফিস, বন্ধুদের আড্ডা, সামাজিক কোন সমস্যার প্রতিবাদ সব কিছুতেই সফলতার বীজ বুনেছে সে। তাই পরিচিত মহলে দিন দিন সে আজকের আদর্শ চরিত্র হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আধুনিক নারী হিসেবে সে অনেকের কাছে আদর্শও বটে। তবে বাড়ির চিত্রটা একটু ভিন্ন। এক বন্ধুর উপস্থিতিতে বাড়ির ছোট্ট গৃহপরিচালিকার সামান্য অসচেতনতার জন্য তাকে চর দিতেও কার্পণ্য করে না। আর তা নিয়ে স্বামীর সাথে তুলকালাম হৈ চৈ এ যেন অপলার সবটুকু সাফল্যের উপর ঠান্ডা পানি ঢেলে দেয়া। ম্লান হয়ে যায় তার আধুনিকতা। নিজের অবস্থাকে কোন ক্রমেই সে খাটো করে দেখতে নারাজ। অপলা কিছুদিন আগে শাশুড়ির কাছ থেকে আলাদা হন। ছেলেবেলা থেকে পড়াশোনাসহ নাচগানেও ভাল করা অপলার দিকটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত। তাই যখন বাড়ির কাজের লোক আর মা-বাবার সাথে সে একটুতেই মেজাজ করতো, তখন এত ক্ষেত্রে উজ্জ্বল পথ চলা যার তার বাড়িতে সব ঠিকঠাক না থাকলে একটু মেজাজ তো হতেই পারে ভেবে মেনে নেয়া হত। আর অবলীলায় বলা হত আজকালের মেয়েরা একটু এমনই হয়। সত্যি কি তাই! নাকি অপলার মতো অনেক মেয়েই সাফল্যের চূড়ায় দাঁড়াতে গিয়ে কোথায় যেন একটু নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। পড়াশোনা, কম্পিউটার, নাচ-গান শেখা, সংগঠন করা, অফিস কত কাজ তাদের। এত কিছুতে জড়াতে গিয়ে নিজের মানসিক বোধ থেকে কি একটু সরে যাচ্ছে কেউ কেউ! তাই অহেতুক ছোট্ট কাজের মেয়ে কিংবা রিক্সাওয়ালার সাথে অশোভন আচারণ করছে। কিংবা অনাবৃত শরীরে ছোট্ট যে মেয়েটা অনবরত ‘আপা ফুল নেন ফুল নেন’ বলছে তাকে নিয়ে নিদারুণ মজা করছে। সত্যিকার অর্থে এই কি আধুনিকতা? সময়ের সাথে আধুনিকতার সংজ্ঞাও পাল্টে যায়। যখন মেয়েদের চারদেয়ালে বন্দী থাকতে হতো, তখন সে দেয়াল ভেঙ্গে নিজেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা ছিল আধুনিকতা আর প্রগতিশীলতার দৃষ্টান্ত, আজ একবিংশ শতাব্দির নারীর জায়গা মাটি থেকে শুরু করে আকাশে উড়ে যাওয়ার সীমা অতিক্রম করেছে। তবে কেন এই মানবিকতার বিকাশ নেই? এই প্রশ্নের জবাবে আইন শালিস কেন্দ্রের প্রাক্তন পরিচালক হামিদা হোসেন বলেন, ‘আজকের মেয়েদের সামাজিক ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখে আমি আনন্দিত, লালনের ভাস্কর্য অপসারণ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়-এ শারীরিক মিলন হয়রানীর প্রতিবাদ সবক্ষেত্রেই তাদের অংশগ্রহণ আছে। তবে নিজের বাড়ির কিংবা আশেপাশের অবহেলিত মানুষের জন্য অনেকের আবেগ কেন সেভাবে জাগ্রত হয় না সেটা তাদের খুঁজে বের করতে হবে আর সচেতন হতে হবে সে বিষয়ে। কারণ আধুনিক নারীর দায়িত্ব সবক্ষেত্রে।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী লাক্স সুন্দরী মম এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমরা পাঁচ মাস ধরে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সেই ছাত্রীর জন্য প্রতিবাদ করছি। অন্য ডিপার্টমেন্টের মেয়েরাও এসেছে। এটা আমরা করছি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে। তবে খুব কাছের অবহেলিত মানুষ আর ঘটনাকে উপেক্ষা করা আর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকাকে আমি কোনভাবে আধুনিকতা বলবো না। বর্তমান প্রজন্মের অনেক মেয়ের মধ্যে এই উদাসিনতার মূল কারণ সময়। আমার ভবিষ্যত আমাকে যেন একটা নিরাপদ অবস্থা দেয়- তা নিয়ে সে চলে আমাদের প্রতিযোগিতা। তাই আমরা এই বিষয়গুলোর দিকে সেভাবে তাকাতে পারি না। তবে সময় এমন থাকবে না।’ নিজেদের প্রজন্মের কারো কারো মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে উদাসিন হওয়াকে সমর্থন না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী মৌমিতা রায় বলেন, ‘আজ আমরা প্রতিনিয়ত কথা বলছি। একান্ত নিজের সমস্যা নিয়েও খোলামেলা কথা বলতে আমাদের বাঁধে না। পাশাপাশি এটাও ঠিক দিন দিন আমরা ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। তাই তো সুবিধা বঞ্চিতদেরকে করছি উপেক্ষা। মানুষ হওয়ার চেয়ে পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করার পথে নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহারই বেশি করছি। মানবতার এই খান্তি কারোই কাম্য নয়।’
অনেকের মতে বাড়ির প্রবীণ উপেক্ষা আর কাজের লোকদের সাথে দুর্ব্যবহার আজকাল একটা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনই কথা বলতে গিয়ে জনতা ব্যাংকের বিপনন শাখার কর্মরত জিনাত মোশাররফ বলেন, ‘আমর কিশোরী মেয়ে দাদা-দাদীর সাথে প্রায়ই দুর্ব্যবহার করে। যে সময়টায় আমরা ভাবতাম তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমাদের। সে সমসয়টাই আমার মেয়ে বলে দাদু’কে বোঝাতে, বোঝাতে আমার রাগ ধরে যায়। দাদুর জন্য আলাদা শোবার ব্যবস্থা কর। এটা কি সময়ের দোষ কিনা বুঝতে পারি না।’ এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত অভিনেত্রী শম্পা রেজাও নিজের ভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা কোন আধুনিকতা নয়। স্বাভাবিক বা সুস্থ মানসিকতার অভাব। স্বাভাবিক শিক্ষা ও রুচির অভাবে আর নতুন পয়সার প্রভাবেই এরকম মানসিকতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সমাজে অসহিষ্ণুতা দেখা যায়। পারলেই আমরা এ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারবো।
সাহিত্যে নারীর বর্ণনা এসেছে নানাভাবে সময়ের সাথে বদলেছে তার রূপ রঙ। সময়ের প্রভাবেই কি এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে? এই মূল্যবোধের ঘাটতিই বা কেন? কিংবা প্রকৃত অর্থে আধুনিক নারীর কেমন হওয়া উচিত এই প্রশ্ন আমরা রাখি কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কাছে।
তার মতে- আমার কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা অনেক বড় ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। এটাকেই আমি আধুনিকতার মূল ভিত্তি মনে করি। এই ভিত্তির আলোকে যে মানুষ নিজেকে যতবেশি আলোকিত করতে পারবে সেই একজন আধুনিক মানুষ। আধুনিকতা এক ধরনের দর্শন- এটা কোন প্রযুক্তি নয়। এই দর্শন দিয়ে ব্যক্তি মূল্যাবোধ তৈরি হবে- যে নিজের বাইরে কিছু চিন্তা করতে পারে না। তার আধুনিকতায় ঘাটতি আছে বুঝতে হবে। এর বাইরে বিশ্ব নিয়ে তার যত বড় ধারণা থাকুক না কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসব প্রসঙ্গে বলেছিলেন ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী, কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ। সেদিন সে সমস্ত মানুষের সাথে একত্র হইয়া বৃহৎ। সেদিন সে সমস্ত মনুষত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ সে মানুষ মহৎ-এর সাধনা করে সে আধুনিক। এর বাইরে আধুনিকতার আচরণে থাকে ব্যক্তির ক্ষুদ্রতা, থাকে ভঢ়ং। সেটা আধুনিকতার নামাবলি মাত্র। তাতে জৌলুস থাকতে পারে কিন্তু গৌরব থাকে না।’ প্রচলিত রক্ষণশীল জ্ঞান এবং সমষ্টির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নারী আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। নিজের ব্যক্তিত্বকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রকাশ করেছে। এই সময়ের অসচেতনতা তা যেন খর্ব না করে।
–রাবেয়া বেবী
মডেল : হুমায়রা হিমু। ছবি : গোলাম রসূল মারুফ
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ২৪, ২০০৯
Leave a Reply