বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর নানা দেশে বহু সামাজিক আন্দোলন হয়েছে সমাজে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে, অবিচার ও বৈষম্য নিরসন করতে এবং ন্যায় ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে। তবে তা অধিকাংশই ছিল দীর্ঘ সময়ের একটি প্রক্রিয়ার ফসল, যা ধীরে ধীরে একটি আন্দোলনে দানা বেঁধেছে। মানুষের মধ্যে একটি সর্বজনীন অধিকারের ধারণা সৃষ্টি করা, একটি কাম্য পরিবর্তনের পক্ষে মতবাদ ও নিজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রয়াস সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে একটা স্বপ্ন পূরণে নিজ নিজ ভূমিকা চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নের জন্য নিজের কাছে অঙ্গীকার করা, নিজের বিবেকের কাছে শপথ নেওয়া যেকোনো বিচারে একটা দুঃসাধ্য কাজ। আর এ কাজটি সম্পাদন করতে পেরেছে প্রথম আলো। সে জন্য তারা সবার ধন্যবাদার্হ্য।
সর্বাধিক প্রচারিত একটি জাতীয় পত্রিকা হিসেবে সমাজের কাছে নিজের দায়বদ্ধতার উপলব্ধি থেকেই এই শপথ আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন ও গতিশীলতা আনতে পেরেছে প্রথম আলো, যা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি সফল প্রথম পদক্ষেপ। এই দায়বদ্ধতা পূরণের মাধ্যমে প্রথম আলো একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে একটি সামাজিক ইনস্টিটিউশনে রূপান্তরিত হয়েছে। আর তারই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ছিল ১৯ জুন শুক্রবারের আয়োজন। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজারো মানুষের অঙ্গীকার ও শপথের সাত কিলোমিটার দীর্ঘ ব্যানারের প্রদর্শন।দেশকে নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখে, এই দিনকে প্রত্যাশা পূরণের সেই দিনের কাছে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় সবাই। এর জন্য প্রয়োজন সব মানুষের মধ্যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন-সত্য, ন্যায় ও শুভর জন্য নিজে বদলে গিয়ে দেশকে বদলে দেওয়া। সে দিন কক্সবাজারে সবার চোখেমুখে ছিল সেই বিশ্বাসের আলো, যা বলে দিচ্ছিল ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুদ্র হলেও এর সমষ্টিতে তৈরি হবে বিরাট পরিবর্তনের ঢেউ, যা বদলে দেবে বাংলাদেশকে।
১৯ জুন দুপুরেই বিশিষ্টজনদের সঙ্গী হয়ে আকাশপথে উড়াল দিলাম কক্সবাজারে। মনে হলো, আমার জীবনে এটি ছিল সংক্ষিপ্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সফর। আর আমার সফরসঙ্গীরা ছিলেন দেশের বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, চিত্রশিল্পী, চিন্তাবিদ, অভিনেতা, মডেল, বুদ্ধিজীবী, এনজিও কর্ণধারসহ অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। এর আগে এত সুধীজন কখনো একসঙ্গে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। তাই যাত্রাটা ছিল বিশেষ উপভোগ্য। বিশেষ করে, তরুণ শিল্পীরা বিমানযাত্রার পুরো সময়টি গানে আর হাসিতে এমন মাতিয়ে রেখেছিল যে মনে হলো নিমেষে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। কক্সবাজার পৌঁছে প্রথমেই আমরা সুদীর্ঘ শপথের ব্যানার হাতে দাঁড়ানো জনতার কাছে এগিয়ে যাই। দিগন্তহীন আকাশ আর উদ্বেলিত বঙ্গোপসাগরকে পেছনে রেখে সৈকতে ব্যানার নিয়ে আনন্দে উদ্ভাসিত জনগণ আমাদের জায়গা করে দিল তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্যানার ধরতে। তারপর আমাদের সম্মিলিত শপথ পাঠ অনুষ্ঠান। সমুদ্রসৈকতে দাঁড়ানো অগণিত জনতার সামনে নিজের বিবেকের কাছে আমরা অঙ্গীকার করলাম কৃতজ্ঞচিত্তে।
এই দেশ আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। দেশের কাছে আমাদের অনেক ঋণ আছে। সেই ঋণ শোধ করার প্রয়াস পাব আমরা যে শপথগুলো নিয়েছি তা পালনের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে আমরা যে শপথ নিয়েছি তা যেন শুধু শপথই না থাকে, সেটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
পুরো শপথ প্রক্রিয়াকে আমি তিনটা মাত্রিকে দেখি। প্রথমত, একজন শপথ নিতে পারে দৈনন্দিন জীবনযাপনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গীকারের মাধ্যমে যা তাকে একজন সুনাগরিক ও সংবেদনশীল মানুষে পরিণত করবে। যত্রতত্র আবর্জনা না ফেলা, থু থু না ফেলা, পথ চলতে আইন ভঙ্গ না করা, প্রতিবেশীর প্রতি সহনশীল হওয়া, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য নিজের বাড়িতে গাছ লাগানো ইত্যাদি ছোট ছোট শপথ পালনের মাধ্যমে নাগরিক দায়িত্ববোধ ও মার্জিত সংস্কৃতিকে ধারণ করা যা সার্বিকভাবে দেশে একটা সহায়ক রুচিশীল সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করবে। দ্বিতীয়ত, শপথের মাধ্যমে ব্যক্তি একটি ‘মরাল চয়েস’ বা নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে-অর্থাৎ অন্যায় ও অসত্যের পরিবর্তে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে অঙ্গীকার করা। যেমন, আমি ঘুষ নেব না এবং ঘুষ দেব না, দুর্নীতি থেকে সর্বদা দূরে থাকব, নিয়মিত কর দেব ইত্যাদি। শপথের মাধ্যমে বিবেকবোধকে জাগ্রত করে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে থাকার অঙ্গীকার করতে পারে। তৃতীয়ত, শপথ হতে পারে একটা নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে অবিচল সংগ্রাম ও নেতৃত্ব প্রদান করার-যেমন করেছিলেন বেগম রোকেয়া এক শ বছর আগে নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনের পক্ষে তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করে সেই লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম ও নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে।
প্রথম আলো বদলে যাও বদলে দাও ্লোগানের পক্ষে একটি নৈতিক অবস্থান নিয়েছে এবং সেই অবস্থান থেকেই তারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে অঙ্গীকার বাস্তবায়নে। প্রথম আলোকে মনে রাখতে হবে, এ পথের সবটুকু তাদের পরিক্রম করতে হবে-এ পর্যন্ত শুধু প্রথম ধাপে পৌঁছানোর কাজ হয়েছে। এ চলমান প্রক্রিয়ায় আমরাও থাকব প্রথম আলোর পাশে। কারণ আমরা যারা আজ সমাজের একটা অবস্থায় আসতে পেরেছি সুযোগের কারণে, আমাদের জন্যও সময় এসেছে বৃহৎ দায়িত্ব নেওয়ার, নেতৃত্ব দেওয়ার এবং আমাদের সবার সম্মিলিত শপথ পালনের মধ্য দিয়ে প্রিয় এ দেশটাকে বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছি।
কক্সবাজারে হাজারো কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছি আমরা, সেই সুরের মধ্যে কোনো খাদ ছিল না। আবেগভরে দ্ব্যর্থ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছি আমার দেশটাকে আমি ভালোবাসি। সোনার বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করতে বড় দরকার ছিল এ রকম অঙ্গীকারের, শপথের। দেশকে ভালোবেসে আজীবন এ শপথ পালন করে যাব। আশা রাখি, শপথ নেওয়া প্রতিজনই দেশের প্রতি এমন ভালোবাসাই দেখাবেন।
সালমা খান
সভাপতি উইমেন ফর উইমেন ও নারী নেত্রী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৪, ২০০৯
Leave a Reply