শপথ ব্যাপারটাই অন্য রকম। শপথ করা মানে নিজের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। সমাজের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। অন্যান্য স্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচি থেকে এর পার্থক্য এখানেই। প্রথম আলো ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘বদলে যাও বদলে দাও’ ধারণায় যে শপথ গ্রহণ কর্মসূচির আয়োজন করেছিল, তা সত্যিই মহতী উদ্যোগ। সমাজের বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। প্রায় দুই লাখ শপথে ব্যানারগুলো ভরে উঠেছিল। সেগুলো একসঙ্গে দেখার সুযোগ মেলে কক্সবাজারে।
‘আমার গ্রামে একটি প্রসূতি মা-ও যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়, সন্তান জন্মগ্রহণের আগে ও পরে প্রসূতিরা যেন সঠিক সেবা ও চিকিৎসা পায়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাব।’ এমনই একটি শপথ আমি নিজেও করেছিলাম।
এই শপথ করার আগে থেকেই আমার গ্রামে কাজ করে যেতাম। কিন্তু নিজের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার পর অন্য রকম তাড়না বোধ করছি। এ রকম লাখো শপথের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের অনুভূতি। কারণ, মানুষ তার মেধা, মনন ও মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে, চিন্তা-ভাবনা করেই কোনো কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। সে যা পারবে বা করতে চায়, তখনই শপথ গ্রহণ করে। ১৯ জুন কক্সবাজারে এসব কথাই মনে পড়ছিল। দুটি বিষয় খুবই ভালো লেগেছে। সবার খুবই স্বতঃস্কূর্ত অংশগ্রহণ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের। এ আয়োজনে গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে জনগুরুত্বের বিষয়টি। সমাজের বিশিষ্টজনেরা নানা রকম অঙ্গীকার করেছেন। সেখান থেকে সমাজে নেতাদের অঙ্গীকারগুলো পেয়েছি। তাঁদের শপথ পরবর্তী সময়ে দেশের নতুন সংস্কৃতি তৈরিতে সহায়তা করবে। অতীতে ১৯৫২-১৯৮৯ পর্যন্ত আমরা নানা রকম শপথ করেছিলাম। কিন্তু আশাব্যঞ্জক কিছু পাইনি। তা ছাড়া নির্বাচিত নতুন সরকার ও বিরোধী দল নির্বাচনের আগে বিভিন্ন রকম অঙ্গীকার করেছিল। তাই আশা করছি এ সময় প্রথম আলোর এই উদ্যোগ দেখে তারা তাদের অঙ্গীকার পূরণের পথে এগিয়ে যাবে।
কক্সবাজারে ব্যানারে লেখা শপথগুলো পড়ে আরেকটি বিষয় মনে হয়েছিল। মানুষ তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই শপথ করেছে। সেদিনের অনুষ্ঠানে শুধু শপথ করা নয়, তা বাস্তবায়নের কথাও ্নরণ করে দিচ্ছিল। এই দায়িত্ব এ দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেশি। যাঁরা ব্যানারে লিখেছেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে তাঁরা শিক্ষিত। তাঁরাই তাঁদের শপথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্যকে সহায়তা করবেন। সরকারকেও সব কল্যাণমূলক কাজে সহায়তা করবেন। এ অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ লক্ষণীয় ছিল। ব্যক্তিপর্যায়ের শপথগুলো কার্যকর করতে পারলেই বড় ধরনের সামজিক সমস্যা দূর হবে। আর কোনো কিছুর পরিবর্তন একবারে হয় না। সময় লাগে। তাই থেমে না গিয়ে আমাদের কাজগুলো করে যেতে হবে। প্রথম আলোর এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি আশা করছি পাঁচ বছর পরে প্রথম আলো এ শপথগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, এর বিশ্লেষণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করবে। যাতে আমরা যারা শপথ করেছি, তারা আত্মবিশ্লেষণ করতে পারি। কারণ, নিজে না বদলালে কিছুই বদলাবে না। কক্সবাজারে যে হৃদ্যতা, মানুষের সঙ্গে মানুষের যে একাত্মতা দেখেছি, তাতে আমি মুগ্ধ। এমন একাত্মতাই পারে নিজেকে বদলাতে, দেশকে বদলাতে।
রাশেদা কে চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৪, ২০০৯
Leave a Reply