রূপাদের দুই বোন এক ভাই নিয়ে সুখের সংসার। হঠাৎ তাদের সুখের সংসারে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। বাবা স্ট্রোকে মারা যান। ছোটখাটো সরকারি চাকরি করা বাবা তেমনভাবে কোনো কিছুই গুছিয়ে যেতে পারেননি। একমাত্র ভাই খুবই ছোট। রূপার মা সন্তানদের নিয়ে অকূল সাগরে পড়লেন। সে সময় রূপার জন্য ভালো একটি বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে কম্পিউটার প্রকৌশলী। রূপা তখন সবে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনায় মেধাবী রূপা আপত্তি জানালেও তাতে কর্ণপাত না করে তার মা দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় রূপা মা হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞানের ছাত্রী রূপার তখন পড়াশোনা চালিয়ে নিতে নামতে হয় এক প্রাণান্তকর সংগ্রামে।
রূপা তাঁর রোজনামচা সম্পর্কে জানান, ‘যেহেতু আমি আর আমার স্বামী ছোট একটা কাজের মেয়ে নিয়ে থাকি, সে ক্ষেত্রে বাসার বেশির ভাগ কাজই আমাকে করতে হয়। প্রতিদিন সকাল ছয়টায় উঠে বাচ্চার খাবার তৈরি করে নিজেদের নাশতা বানাই। এরপর কাজের মেয়েকে ভালো করে সারা দিনের কাজ আর বাবুর ব্যাপার বুঝিয়ে ক্লাসে চলে যাই। ক্লাসে গিয়ে সারাক্ষণই একটা চাপা টেনশনে থাকি। বাবুর কিছু হলো না তো? মেয়েটা ঠিকমতো খাওয়াচ্ছে তো? দম বন্ধকর অবস্থায় কোনোমতে ক্লাস শেষ করে বাসায় গিয়ে আবার রাতের রান্নার তদারকি করি। এরপর সন্ধ্যায় স্বামী অফিস থেকে ফিরলে ওর কাছে বাচ্চাকে দিয়ে নিজের পড়াশোনা তৈরি করি। একটানা তো পড়াও যায় না।’
ক্লাসে প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকা রূপা আগের মতো ফলাফল না করলেও থেমে যাননি, মনের জোর বজায় রেখে ঠিকই আজ স্মাতকোত্তর শ্রেণীতে পড়ছেন, ফলাফলও ভালো করছেন।
কিন্তু বাচ্চার যখন অসুখ হয় বা নিজের পরীক্ষা থাকে, তখন কী অবস্থা হয়? এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণু জীববিজ্ঞানের ছাত্রী স্মাতক (সম্মান) শ্রেণীতে স্বর্ণপদক পাওয়া এখন স্মাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্রী সুমাইয়া হাসান-‘আমার বিয়ে হয়েছে স্মাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে থাকার সময়। তৃতীয় বর্ষ চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় বাচ্চা হওয়ার কারণে আমার ছয়টি ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরে শিক্ষকেরা শুধু আমার জন্য সে পরীক্ষাগুলো আবার নেন। আমার মা-বাবা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাই বাবু হওয়ার পর আমি মা-বাবার সঙ্গে কোয়ার্টারে থাকতাম। সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাস থাকত। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত টানা ক্লাস করে দুপুরে ল্যাব করতে হতো। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে যে সময়টুকু থাকে তখন দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাকে খাইয়ে আসতাম। প্রায়ই ক্লাসে দেরি হয়ে যেত। তবে আমার বন্ধুরা আর শিক্ষকেরা সব সময়ই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। রাতে যখন পড়তাম তখন বাচ্চাকে আমার মা-বোনেরা সামলাত। কিন্তু দেখা গেছে আমার পরীক্ষা, এদিকে বাবুর অসুখ। যদিও মা-বোনেরা সামলাচ্ছে, কিন্তু মনটাকে সে সময় শান্ত রাখা যে কী পরিমাণ কষ্টকর তা বোঝানো কঠিন।
এ ছাড়া এসবের মধ্যে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সপ্তাহে দুই দিন সেখানে গিয়ে থাকা, কিছু দায়িত্ব পালন করা-এসবও করতে হচ্ছে। এত কিছু করেও ক্লাস বাদ দিতাম না। মাঝেমধ্যে মনে হতো পড়াশোনার এই বোঝা বুঝি আর টানতে পারব না। এ যেন সময়ের প্রতিটি সেকেন্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার এক ক্লান্তিহীন যুদ্ধ। কিন্তু আমার মা আমাকে সাহস দিতেন, তিনিও আমাদের তিন বোনকে নিয়ে অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন। আমার স্বামী আমাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছেন। আমার পড়াশোনা, অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির কাজে সাহায্য করেছেন। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার মনের শক্তি। এ শক্তিই আজ আমাকে এত দূর এনেছে।’
সুমাইয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা থাকা সত্ত্বেও অনেক মেয়েকেই পড়াশোনার মাঝখানে বিয়ে হয়ে বাচ্চা হওয়ার দরুণ বাধ্য হয়ে ‘ইয়ার ড্রপ’ দিতে হয়। আবার অনেকেই পড়াশোনায় অনিয়মিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তা আর সমাপ্ত করেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী রাত্রি বলেন, ‘যেহেতু আমি ঢাকায় থাকি এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূর, তাই এত ছোট বাচ্চা নিয়ে পড়াশোনা চালাতে পারছি না। আমার বাচ্চার বয়স যখন ২০ দিন, তখন আমার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। একটা ছোট কাজের মেয়ে বাচ্চাকে নিয়ে হলের বাইরে থাকত। আমি পরীক্ষার মাঝ থেকে উঠে এসে বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করাতাম। থার্ড ইয়ার ফাইনালের সময় ওর ডায়রিয়া হলে আমাকে এক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। তাই সে বছর বাধ্য হয়ে ইয়ার ড্রপ দিতে হয়েছে। তবে বাচ্চা একটু বড় হলেই আমি আবার পড়াশোনা শুরু করব।’
‘বাচ্চা হওয়ার কারণে হয়তো ইয়ার ড্রপ যেতে পারে, কিন্তু একেবারে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয় এবং এ ক্ষেত্রে একটি মেয়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাঁর স্বামীর সহযোগিতা ও নিজের এবং শ্বশুরবাড়ির মানুষের পূর্ণ সমর্থন।’ বললেন বরিশাল মেডিকেল কলেজের ছাত্রী বর্তমানে ঢাকার পিজি হাসপাতালে শিক্ষানবিস চিকিৎসক তানিয়া নূর। ‘আমার অনেক বন্ধুই পড়াশোনার মাঝখানে বিয়ে হয়ে বাচ্চা হওয়ায় তারা আর সেটা চালিয়ে যায়নি। আমার বাচ্চা হওয়ার পর আমিও ভেবেছিলাম আর হয়তো ডাক্তার হতে পারব না। আমার স্বামীর অনুপ্রেরণা আর বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সহযোগিতাই আমাকে আজ এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।’ তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সব মেয়ের ভাগ্যে এই সহযোগিতাটুকু না-ও জুটতে পারে। তাই সব মেয়েরই উচিত আগে পড়াশোনা শেষ করে তারপর বিয়ে করা।
রওশন আক্তার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৪, ২০০৯
Leave a Reply