সন্ধ্যার পর পরই চললাম শ্রীমঙ্গল শহরের পূর্বাশা আবাসিক এলাকায়। সেখানে পৌঁছে ‘প্রাঞ্জল’ নামের ছোট্ট একটি মহল্লার গলিপথে প্রবেশ করলাম আমরা। এই পথের শেষ মাথায় ১৫ নম্বর বাড়ি। সুন্দর ছিমছাম এই বাড়িটির উঠানে পা রাখলাম। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিলেন বাংলাদেশের চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম সরকারি চাকরিজীবী নারী সন্ধ্যা রানী বসাক। আমরা বসার ঘরে বসলাম। স্বামী মানিকলাল রায়কে পাশে নিয়ে বসলেন সন্ধ্যা রানী বসাকও। আলাপচারিতা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে লক্ষ করলাম প্রৌঢ় এই দম্পতির মুখে বিষাদের ছাপ। জানা গেল, মাত্র দুই মাস আগে মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়েছে এই বাড়ির একমাত্র ছেলে মনোজ কান্তি রায়ের প্রাণ। ‘ভীষণ মেধাবী ছিল ছেলেটা। বিবিএ পড়ত ঢাকায়। শুধু লেখাপড়াই নয়, খেলাধুলাও নিয়মিত করত সে। এ ছাড়া নানা রকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তার উপস্থিতি ছিল প্রাণবন্ত। ভেবেছিলাম বছর তিনেকের মধ্যে ছেলের বিয়ে দেব।কিন্তু তা আর হলো কই?’ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে সন্ধ্যা রানী বসাকের বুক চিড়ে। অশ্রুসিক্ত হয় তাঁর দুই চোখ। বিষণ্ন মানিকলাল রায়ের মন আরও বিষণ্ন হয়।
সন্ধ্যা রানী বসাক পুত্রশোক সামলে নেন কিছু সময়ের জন্য। অনির্বচনীয় এক বেদনা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলে আসা জীবনের কথা বলেন ধীরে ধীরে, সংক্ষেপে।
সন্ধ্যা রানী বসাকের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২০ আগস্ট, সিন্দুরখান চা-বাগানের শ্রমিকনিবাসে। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় সিন্দুরখান চা-বাগান মূলত রাজঘাট চা-বাগানের অন্তর্গত একটি ফাঁড়ি বাগান। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সপ্তম সন্ধ্যা রানী বসাক একেবারে শৈশবেই উপলব্ধি করেছিলেন চা-শ্রমিক পরিবারে জন্ম নেওয়ার নিদারুণ কষ্টকে। এই কষ্ট থেকে উত্তরণের কি কোনো পথ নেই? সন্ধ্যা রানী বসাক বুঝেছিলেন, একমাত্র শিক্ষাই পারে ব্যক্তিমানুষের কষ্ট ঘুচিয়ে দিতে।
সিন্দুরখান চা-বাগানের হাসপাতালের ড্রেসার ভ্রমর তাঁতির মেয়ে তৃপ্তি তাঁতি ছিলেন সন্ধ্যা রানী বসাকের বন্ধু। সেই ছেলেবেলা থেকেই দুজনের ভাবনা, চিন্তা, জীবনবোধের প্রকৃতি প্রায় একই রকম। সন্ধ্যা রানী বসাকের শিক্ষাসংক্রান্ত বোঝাপড়ার সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন তিনিও। তাই দুই বান্ধবী একসঙ্গে ভর্তি হলেন রাজঘাট জুনিয়র হাইস্কুলে। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়লেন এখানে। তারপর শ্রীমঙ্গল দীনময়ী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তাঁরা। কিন্তু সিন্দুরখান চা-বাগান থেকে এই বিদ্যালয়ের দূরত্ব যে অনেক! আসা-যাওয়ার পথে সমস্যাও যে বিস্তর! কিন্তু আলোকপ্রাপ্ত মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মরিয়া তখন দুই বান্ধবী। শ্রীমঙ্গল স্কুলের হোস্টেলে জায়গা করে নিলেন তাঁরা। তারপর শুরু হলো সাধনা। কঠোর অনুশীলন। অষ্টম শ্রেণী, নবম শ্রেণী, দশম শ্রেণী-অতঃপর ম্যাট্রিকুলেশন।
সন্ধ্যা এবং তৃপ্তি ভালোভাবেই জানতেন, বাংলাদেশে চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো নারী আজ অবধি অতিক্রম করেননি স্কুলের গণ্ডি। ১৯৬৭ সালে সাফল্যের সঙ্গেই উত্তীর্ণ হলেন তাঁরা। তারপর বাড়ি থেকে বহুদূরে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে কলা বিভাগে ভর্তি হয়ে বাংলাদেশে চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কলেজপড়ুয়া নারী হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন দুজন। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চোখ আটকাল সন্ধ্যা রানী বসাকের। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে মহিলা পরিদর্শক প্রয়োজন। বলা যায়, প্রান্তিক জীবনের ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতেই চাকরির জন্য আবেদন করলেন সন্ধ্যা রানী বসাক। আত্মবিশ্বাসী ছিলেন চাকরিটা হবে-হলোও। সুতরাং লেখাপড়া করা আর হলো না সন্ধ্যা রানী বসাকের। এদিকে বান্ধবীকে ছাড়া তৃপ্তি তাঁতি পড়বেন না। তাই তিনি কলেজ ছেড়ে গ্রামে ফিরে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন।
১৯৬৮ সালের আগস্ট মাসে চাকরিতে যোগ দিলেন সন্ধ্যা রানী বসাক। চট্টগ্রামে ১৫ মাসের ট্রেনিং শেষে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে কুলাউড়ায় পোস্টিং হলো তাঁর-জীবনের বিশেষ কথাগুলো বলতে বলতে এখানেই থামলেন বাংলাদেশে চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম সরকারি চাকরিজীবী নারী।
দীপংকর চন্দ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৪, ২০০৯
Leave a Reply