গরমকালের আম-কাঁঠাল প্রিয় হলেও কাঠফাটা রোদ কারও পছন্দ নয়। তার ওপর যখন দেখা যায় ক্ষতি হচ্ছে আপনার ত্বক ও চুলের, তখন কারই বা ভালো থাকে। গরমে চুল ও ত্বকের যত্ন কীভাবে নেবেন, তা জানিয়েছেন রূপবিশেষজ্ঞ ফারজানা আরমান।
ফেইস ওয়াশঃ সকাল থেকেই শুরু হওয়া উচিত ত্বকের কিছু পরিচর্যা। সময় বা খরচ কোনোটাই বেশি হবে না। বরং খুঁটিনাটি কিছু ব্যাপারের প্রতি খেয়াল রাখলেই চলবে। গরমে সতেজ থাকার মূলমন্ত্রই হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এর জন্য ত্বক বুঝে বেছে নিন ফেইস ওয়াশ। শুষ্ক ত্বকের অধিকারীদের দরকার গ্লিসারিনসমৃদ্ধ সাবান বা ফেইস ওয়াশ। এর পরিপূরক হতে পারে ময়েশ্চারাইজারসমৃদ্ধ ক্রিম ক্লিনজার। তবে গরমের সময় সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ফেইসিং ক্লিনজার। কারণ, ধুলোবালিসহ বাড়তি ময়লা পরিষ্কার করতে এটি সক্ষম।
স্ক্রাবঃ গরমে ত্বকের রং স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করবে স্ক্রাব। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ব্যবহার করা আবশ্যক। এটি প্রয়োজন মনে না হলেও টোনার ভালো কাজ দেবে এ গরমে।
ক্রিমঃ শুষ্ক ত্বকে বলিরেখা তাড়াতাড়ি পড়ে। এ কারণেই বছরের সব সময় ক্রিমের প্রয়োজনীয়তা আছে। ভারী ময়েশ্চারাইজারসমৃদ্ধ ক্রিম তাই এ গরমেও হোক আপনার সঙ্গী।
তবে যাঁদের ত্বক সাধারণ ও মিশ্র, তাঁদের জন্য ক্রিম একটু অন্য রকম। পানির পরিমাণ বেশি এবং তেলের পরিমাণ কম। এ ধরনের ক্রিমই সহায়ক এ দুই ধরনের ত্বকে।
সানস্ক্রিনঃ রোদ অসহ্য হলেও বাইরের কাজকর্ম তো আর বন্ধ করে দেওয়া যায় না। সূর্যের কিরণকে মোক্ষম জবাব দেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে হবে সানস্ক্রিন। নমনীয় ত্বকের জন্য মেডিকেটেড সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। এবং তৈলাক্ত ত্বকের জন্য তেলবিহীন সানস্ক্রিনই প্রযোজ্য।
ওয়াইপসঃ গরমে ওয়াইপসের দরকার একটু বেশি। ঘণ্টা খানেক বাইরে থাকলেই ত্বকে ময়লা জমে যায়। ক্লিনজিং ওয়াইপসগুলো আপনাকে সাহায্য করবে বিনা ঝামেলায় ময়লাগুলো মুছে ফেলতে ও ঘামটা পরিষ্কার করতে।
চোখের নিচের কালিঃ শুধু ত্বকের ক্ষতি নয়, চোখের নিচে কালি ফেলার জন্য সূর্যরশ্মি দায়ী। । তাই প্রতিদিন ব্যবহার করুন আইজেল।
ব্রণ এড়াতেঃ ত্বক ঠিক রাখতে প্রতিদিনের খাবারের প্রতি নজর দিন। ভাজাপোড়া, বেশি মশলা দেওয়া খাবার, ফাস্টফুড ক্ষতি করবে আপনার ত্বকের। বরং এর বদলে বেশি করে শাকসবজি ও ফলমূল খান। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন চা, কফি ও লবণাক্ত খাবার। পান করুন প্রচুর পানি। দিনে কমপক্ষে আট গ্লাস। খুঁটিনাটিতেই সজীবতা
— রোদের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি থাকে সকাল ১০টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত। ত্বকের যা ক্ষতি এ সময়ই হয়। ব্যবহার করুন ছাতা। কালো এড়িয়ে কিনুন উজ্জ্বল রঙের ছাতা।
— যতটা সম্ভব কম মেকআপ ব্যবহার করুন, বিশেষ করে দিনের বেলা।
— সঙ্গে রাখুন ওয়াইপস, ব্লটিং পেপার। তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারীরা সারা দিন থাকতে পারবেন সজীবতার স্পর্শে।
— ব্যবহৃত সানস্ক্রিনটির এসপিএফ যেন ৪০-এর ওপরে হয়।
— সানস্ক্রিন কাজ করে মূলত চার-পাঁচ ঘণ্টা। এরপর আবার মুখ পরিষ্কার করে এটি লাগাতে হবে।
— তরমুজ, পেঁপে এবং গ্রী্নকালীন অন্যান্য ফলের রস মুখে লাগান, ত্বকের পোড়া ভাব দূর হবে।
— গরমে তরল ফাউন্ডেশন ব্যবহার করবেন না।
— গ্রী্নে অ্যালকোহলমুক্ত টোনার ব্যবহার করবেন ।
এ তো গেল সাধারণ কিছু খুঁটিনাটি পদক্ষেপের কথা। এ ছাড়া বাসায় বসেই মুখের যত্নে কিছু মাস্ক তৈরি করে ফেলুন।
তৈলাক্ত ত্বকঃ তৈলাক্ত ত্বকে সজীবতা বজায় রাখতে ব্যবহার করুন এ মাস্কটি। আধা চামচ লেবুর রস, একটি ডিমের সাদা অংশ, এক চা-চামচ মধু ও স্ট্রবেরি। সবকিছু একসঙ্গে ব্লেন্ড করুন। মুখে লাগান ১০ মিনিটের জন্য। ধুলেই দেখবেন ত্বকে ফিরে এসেছে উজ্জ্বলতা। এ ছাড়া তৈলাক্ত ত্বকে প্রতিদিন ব্যবহার করুন ফেইসিং ক্লিনজার এবং তেলবিহীন ক্রিম।
শুষ্ক ত্বকঃ প্রতিদিন ক্রিমি ক্লিনজার দিয়ে ত্বক ধুয়ে ফেলুন। একটি স্ক্রাব ব্যবহার করুন, বিশেষ করে নাকের দিকে। ক্রিম হিসেবে ব্যবহার করবেন ভারী ময়েশ্চারাইজার।
শুষ্ক ত্বকের প্যাক-আধা চামচ মধু, একটি কলা ও বাদাম। বাদাম গুঁড়ো করে কলা ও মধুর সঙ্গে মিশিয়ে নিন। ১০ মিনিট মুখে লাগিয়ে রাখুন। কোমল ভাব আনতে এটি সাহায্য করবে।
মিশ্র ত্বকঃ একটি গোলাপ ফুলের পাপড়ি নিয়ে কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। তার সঙ্গে দিন এক চা চামচ গোলাপপানি, আরও দিন এক চা চামচ টক দই এবং এক চা চামচ মধু। মিশিয়ে ১০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন।
নমনীয় ত্বকঃ ক্লিনজার বা ফেইস ওয়াশ যদি আপনাকে না মানায়, তাহলে ব্যবহার করুন ফেইসিয়াল ওয়াইপস। আপনার ত্বকে দরকার একটু বাড়তি যত্ন। তাই সানস্ক্রিনটি হতে হবে ত্বকের সঙ্গে মানানসই। আপনার ক্রিমটি হবে হালকা ময়েশ্চারাইজারযুক্ত। দই ভালোভাবে ব্লেন্ড করে মুখে লাগান, উপকার পাবেন।
চুলঃ গরমে চুলের যত্ন নেওয়া আবশ্যক। চুলের ধরন বুঝে, চুলকে জেনে যত্ন নিতে হবে। গরমে প্রতিদিন চুল ধোয়া উচিত। কারণ, ঘামের কারণে চুলে ময়লা আটকে যায়। ফলে চুল গোড়া থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। অতঃপর চুল পড়ে যায়। শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধোয়া তাই এ গরমে হোক আপনার প্রতিদিনের কাজ। ‘সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা জানান, তৈলাক্ত চুল হওয়ায় তিনি তেল ব্যবহার করেন না। তবে যখন করেন তখন নারিকেল তেলের সঙ্গে লেবু ব্যবহার করে লাগান। হেয়ার ড্রায়ারও ব্যবহার করেন না। চুল শুকিয়ে নেন ফ্যানের বাতাসেই। জানালেন ঘরোয়া পদ্ধতিতে তার দেওয়া প্যাকের কথা-মুলতানি মাটি, লেবু, নারিকেল তেল, ডিমের সাদা অংশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে মাথায় লাগান। এক ঘণ্টা রেখে ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। পরদিন শ্যাম্পু করতে হবে।
লম্বা চুল কখনোই বোঝা মনে করেন না সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা। স্বামী এবং বন্ধুদের কাছ থেকে প্রশংসিত হোন বলে লুকটা কখনোই বদলাবেন না তিনি।
শুষ্ক চুলের পরিচর্যা
কারও কারও চুল শুষ্কই থাকে। কারও আবার অবহেলা, রং ব্যবহার, রিবন্ডিং অথবা আয়রন করার কারণে চুলে শুষ্কতা চলে আসে। এ ধরনের চুলে দরকার ময়েশ্চারাইজিং শ্যাম্পু, লিভ ইন কন্ডিশনার এবং গরম তেলের আলতো ম্যাসাজ।
বাসায় বানিয়ে লাগিয়ে ফেলতে পারেন ঘরোয়া একটি প্যাক।
যা যা লাগবে-একটি ডিম, মাখন, পনির, জাম্পুরা বা কমলা ও পানি। একসঙ্গে সব উপকরণ মিশিয়ে ব্লেন্ড করে নিন। আধা ঘণ্টা লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন।
তৈলাক্ত চুল
যত্ন দরকার তৈলাক্ত চুলেরও। প্রতিদিন চুল ধোয়া বাধ্যতামূলক। এটি খুশকি হওয়া থেকে বিরত রাখবে। ইউভিসমৃদ্ধ শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার ব্যবহার করুন এ গরমে।
মনে রাখুন
— কন্ডিশনারযুক্ত শ্যাম্পু একনাগাড়ে বেশি দিন ব্যবহার করবেন না
— পানি দিয়ে ভালোভাবে শ্যাম্পু ধুয়ে ফেলুন
— পেট ঠান্ডা রাখুন। তাহলেই সব ঠিক থাকবে। পানি, তরমুজ, টমেটো খেলে উপকার পাবেন।
ঘামঃ আমাদের দেশে গরম মানেই ঘাম। এর থেকে নিস্তার নেই, তবে কিছু উপায় আছে ঘাম কমিয়ে আনার। লেজার মেডিকেল সেন্টারের কনসালট্যান্ট ডারমাটোলজিস্ট ঝুমু খান জানান এ ব্যাপারে কিছু চিকিৎসার কথা। ‘পরিবেশটার কারণেই ঘাম হওয়া স্বাভাবিক। এ সময় যতটা সম্ভব আমাদের ঠান্ডা অবস্থায় থাকা উচিত।’ তিনি আরও জানান, ‘গরমের সময় আমাদের ঘামের গ্রন্থিগুলো বেশি সক্রিয় হয়। ঘামের দুর্গন্ধ বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে অ্যাপোক্রাইন গ্ল্যান্ড। কারও কারও ক্ষেত্রে এই গ্রন্থি বেশি সক্রিয় থাকায় ঘামের গন্ধ বেশি হয়।
অ্যালুমিনিয়াম হেক্সাক্লোরাইড ওষুধ ব্যবহার করলে ঘামের বিরক্তিকর ব্যাপার থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে।’ যাঁদের বেশি ঘাম হয়, তাঁদের তিনি বোটোক্স ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আয়ানটোফোরোসিস চিকিৎসাও সহায়তা করবে ঘামের সমস্যা কমাতে। এ ছাড়া সাধারণ কিছু নিয়ম তো আছেই।
— বেশি পরিমাণে পানি পান করা
— ফলের রস খাওয়া
— সুতির কাপড় পরা
— দরকার হলে দিনে দু-তিনবার গোসল করা
— ঘামের ওপর পারফিউম স্প্রে করবেন না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অবস্থায় পারফিউম বা ডিওডরেন্ট ব্যবহার করুন।
রয়া মুনতাসীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০২, ২০০৯
Leave a Reply