কয়েক দিন ধরে সহকর্মী চৈতীর মন খারাপ দেখছেন আনিলা। সদা হাস্যোজ্জ্বল চৈতীর মুখটা অনেকটাই ্লান দেখায়। কারণ জানতে চাইলে এড়িয়ে যান। কাজের অবসরে দুজনের চায়ের মগ হাতে আনিলা যান চৈতীর কাছে। নীরবে জানতে চান সমস্যার কথা। বিষণ্ন মুখে জানান চৈতী গত কয়েক দিন তিনি বাবার বাসায় আছেন। সাংসারিক বিষয় নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মন কষাকষি। একপর্যায়ে রাগ করে বাবার বাসায় চলে যান। কিন্তু এ রকম পরিবেশে তাঁর আর ভালো লাগছে না। মন বসাতে পারছেন না কোনো কাজে। চৈতীর হাতে সহানুভূতির স্পর্শ রেখে আনিলা বোঝান সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলতে। দাম্পত্য কলহ থাকবেই, তবে এটাকে মনে পুষে না রেখে মিটিয়ে ফেলাই ভালো। সহকর্মী চৈতীকে বোঝাতে বোঝাতে মনে উঁকি দেয় নিজের ভাইয়ের সংসারজীবনটা। ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে ভাই আর ভাবির মধ্যে লাগে দাম্পত্য খিটিমিটি। ব্যাপারটাকে আরও বাড়িয়ে একপর্যায়ে তারা আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। মাঝখান দিয়ে ছেলেমেয়েরা হচ্ছে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত। ভাই-ভাবি যদি একটু মানিয়ে চলার চেষ্টা করতেন, কত সুখেরই না হতো তাঁদের সংসারটা। মনে মনে আফসোস করেন আনিলা। আর বোঝান চৈতীকে সমস্যাটাকে মিটিয়ে ফেলতে।
দাম্পত্য সম্পর্কে মান-অভিমান থাকবেই। শরতের মেঘ আর দাম্পত্য কলহ যেন একই রকম। হাসি-তামাশা, মান-অভিমান নিয়েই এ সম্পর্ক। মাঝেমধ্যে অনেক পরিবারে ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি থেকেই ঘটে বিপর্যয়। তিক্ততায় ভরে যায় মধুর সম্পর্কটি। সন্তান, পরিবারের অন্য সদস্যরা হন মানসিক চাপের শিকার। এসব থেকে বেরিয়ে এসে স্বামী-স্ত্রী দুজন যদি একটু সচেতন হন, তবে বিনা কষ্টে দাম্পত্য জীবন হয় মধুময়। একটু মানিয়ে চলা, দুজন দুজনকে বোঝা-এটুকুই দিতে পারে প্রেমময় দাম্পত্য জীবন।
এ রকমই এক দম্পতি রওশন আরা-কাওসার চৌধুরী। ২০ বছরের সাংসারিক জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপই গেছে ছন্দময়, মধুময়। দুই মেয়ের মা-বাবা তাঁরা। মেয়েদের সঙ্গেও সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। কীভাবে পারলেন জীবনটাকে এমন মধুময় করতে, জানতে চাওয়ায় হেসে জবাব দেন-‘দাম্পত্য জীবনে নিত্য টুকটাক বিষয়ে লেগে যাবেই! না লাগাটাই অস্বাভাবিক। একসময় সেটা প্রতিদিন দাঁত মাজার মতো অভ্যস্ততায় পরিণত হয়ে যায়। গুরুতর কিছু না হলে তার আলাদা গুরুত্ব থাকে না। যদি আমার মাথায় থাকে সাংসারিক জীবনে সুখী হওয়ার ইচ্ছা, তবে একটু মানিয়ে চলার মধ্য দিয়ে নিজেকে আমি সে অবস্থানেই পাব। এটা আমি বিশ্বাস করি।’
্নিত হেসে স্ত্রী রওশন আরা বলেন, ‘জীবনসঙ্গী যদি সংসারের প্রতি ইতিবাচক থাকেন, তবে ত্যাগ-তিতিক্ষা, খিটিমিটি জড়িয়ে সুন্দর দাম্পত্য জীবন পাওয়া যাবে। সবকিছুর মধ্যে ভুল ধরতে যাওয়া, সব ব্যাপার নিয়ে কলহের ভাবনা থেকে দূরে থাকলে সম্পর্কটা জটিল হয় না। সন্তানরাও বেড়ে ওঠে সুন্দর পরিবেশে, যা আমি প্রতিমূহূর্তে বুঝতে পারছি।’
দাম্পত্য সম্পর্কের ধরনটাই এমন-কখনো বৃষ্টি কখনো রোদ। তবে আজকের দম্পতিরা সত্যি দিশেহারা। ঘরে-বাইরে জীবন ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। ঘরের কাজকর্ম থেকে শুরু করে বাচ্চাদের লেখাপড়া পর্যন্ত-সবকিছুই কঠিন ও অনিশ্চিত। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিজেদের কর্মস্থলে সমস্যার পর সমস্যা মোকাবিলা করে ক্লান্ত। ঘরে ফিরেও দু-দণ্ড শান্তির অবকাশ নেই। ব্যক্তিত্ব আর আত্মমর্যাদার সংকট প্রবল। তবে দুজনই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতায় মানিয়ে চললে সম্পর্কটা সহজ হয়। একটুখানি মানিয়ে চলায় সুখী দাম্পত্য জীবন নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আফরোজা হোসেন। তিনি মতামত দেন-‘দাম্পত্য জীবনে কলহ অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ভালোবাসা-সমঝোতা-মমতার মতোই মতবিরোধ, মতপার্থক্য দাম্পত্য জীবনের একটা অঙ্গ। কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্ক তখনই অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করে, যখন এর ফল হয় ভুল বোঝাবুঝি, তিক্ততা, পরস্পরকে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রবণতা, অবিশ্বাস ইত্যাদি। বিবাহিত জীবন কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এতে জড়িত পরিবারের অন্যান্য সদস্য, সমাজ-সংস্কৃতি। দুজন স্বতন্ত্র মানসিকতার, ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা আলাদা মানুষ দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় সাধন করে একটা সমঝোতায় পৌঁছে জীবনযাপন করতে চেষ্টা করেন। এখানে মানিয়ে চলাটা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্কে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তর্কে জিততে যাওয়ার প্রবণতা বা নিজের মতকে একগুঁয়েভাবে প্রাধান্য দেওয়াটা দাম্পত্য সম্পর্কে কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’ দাম্পত্য সম্পর্ক যেসব কারণে তিক্ত হতে পারে, তার কথা উল্লেখ করেন আফরোজা হোসেন। তার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা ও একে অপরকে পর্যাপ্ত সময় দিতে না পারা, সাংসারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, মানসিকতার পার্থক্য, তৃতীয় ব্যক্তিকে জড়িয়ে সন্দেহ, মনমেজাজ তিক্ত থাকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি কারণ উল্লেখ করেন। তিনি গুরুত্ব দেন-দুজনের একটুখানি মানিয়ে চলাই সম্পর্কটা সুন্দর করে, সুখী করে।
নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের নকশার সুবন্ধু সমীপেষু বিভাগে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেন। দাম্পত্য সম্পর্কে মানিয়ে চলার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মানিয়ে চলা শুধু দাম্পত্য সম্পর্ক নয়, সব সম্পর্কই সহজ, সুন্দর করে। স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে বলব, মেনে নেওয়াটা যেন একতরফা না হয়। কারণ, আমরা দেখি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরাই বেশি ত্যাগ করে। এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কেননা, আজকের শিক্ষিত ও কর্মজীবী মেয়েদের জন্য দাম্পত্য জীবন একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এখানে তাকে একই সঙ্গে সুদক্ষ অফিসকর্মী, স্ত্রী-বন্ধু, সুচারু গৃহিণী, মা ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হয়। একই সঙ্গে সংসারের সব ঝক্কিঝামেলাও অনেক সময় এক হাতেই সামলাতে হয়। তাই ত্যাগের ক্ষেত্রে, মানিয়ে চলার ক্ষেত্রটা যেন একজনের ঘাড়ে না চেপে যায়, সেদিকটায় সচেতন হতে হবে। ছোটখাটো কিংবা বড় সমস্যায় সমঝোতার মধ্য দিয়ে যদি দুজন সুন্দর মানিয়ে চলেন, তবে সম্পর্কটা অনেক সহজ হবে। মধুর হবে দাম্পত্য জীবন।
জোহরা শিউলী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০২, ২০০৯
Leave a Reply