গাঁয়ের ওই মেঠোপথে চোখ বন্ধ করে কয়েক পা। ঝিঁঝি পোকার ডাকে ভাঙবে স্বপ্নের নিস্তব্ধতা। দোয়েল-কোয়েল আর ময়নায় সুরের ঐকতান। কাকের ডাক কর্কশ মনে হবে না মোটেও। সেই মেঠোপথটার গা ঘেঁষা পাহাড়ি নদীটা কাছে ডাকবে তোমাকে। তীরে বাঁধা বাহারি সাম্পানের সারেং আজ তুমিই। নদীর মাছগুলো ছুটবে তোমার পিছু পিছু। নদীর পানিতে ফুটে থাকা লাল শাপলা, দুই পাশের বনানীর মধ্যে যখন হারিয়ে যেতে থাকবে তখন সংবিত ফিরে আসবে মস্ত কুমিরের বিরাট হাঁ দেখে। একটু ভয় লাগছে? ভয় নেই, সামনে তোমার বন্ধু কচ্ছপ আছে। ইচ্ছে করলে চড়ে বসতে পারো কচ্ছপের পিঠে। পাথুরে নদীটার শুরু দেখতে পাবে আরেকটু এগোলেই। শান্ত সুশীতল এক পাহাড়ি ঝরনা। ঝরনার গা ঘেঁষা সবুজ পাহাড়টাও অনেক সুন্দর। বাঘের হুঙ্কার না? হ্যাঁ, তাই তো। দৌড়ে ঢুকে পড়লাম সেই ঝরনাটার নিচে পাহাড়ি গুহায়। ও···য়া···ও! অসাধারণ গুহাটা। এখানে নিশ্চয়ই গুহাচিত্র আঁকতে ইচ্ছে হবে তোমার। সে ব্যবস্থাও আছে। পাহাড়ি গুহার আলো-আঁধারিতে আঁকিবুঁকি করার অন্য রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে পুরো গুহাটা চষে বেড়িয়ে অন্য আরেকটি গুহামুখ দিয়ে বেরোতে যাবে যখন, একটা বড় চমক অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। বিশাল হাতি অভ্যর্থনা জানাতে আসবে তোমাকে। দুই ধারের সবুজ বনানী অসাধারণ সুন্দর। আম-কাঁঠাল গাছ সবই আছে। এসবের মধ্যে অন্য রকম লাগবে ওপরে থাকা সেই চেনা মেঘলা আকাশটাকেও। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ও মা, ঝরনার ওপরের দিকে ওরা কারা? হ্যাঁ, পরীই তো। তবে এরা আমাদের দেশি পরী। লাল শাড়ি আর এলোচুলে গাঁয়ের গীত ধরেছে। রাতটা আজ এখানেই থাকতে হবে। তাঁবু টানানো হয়েছে। সামনে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থাও আছে।
স্বপ্ন নয়। এটা হৃদয়পুরের সত্যি গল্প। হতে পারে কৃত্রিম, কিন্তু এই কাঠখোট্টা যান্ত্রিক নগরে বেড়ে ওঠা শিশুদের তার হৃদয় তথা শেকড় চেনাতে চমৎকার এই উদ্যোগ নিয়েছে দেশের সৃজনশীল আসবাব ও গৃহশৈলী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অটবি। ঢাকার গুলশান-১ নম্বরের অটবির প্রধান শাখায় শিশুদের জন্য এই স্বপ্নরাজ্যের উদ্বোধন হয় সম্প্রতি। ঘরের মধ্যে শব্দ-আলো আর সৃজনশীল বাস্তবিক উপস্থাপনায় শিশুদের এই স্বপ্নপুরীকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। স্বপ্নের এই রাজ্যের গল্প এখানেই শেষ নয়। সেই মেঠোপথটার পাশে চোখে পড়বে একটা রেললাইন ধরে এগুলেই আসল চমক। একটা ইষ্টিশান। নামটাও অদ্ভুত ‘লাল ফড়িং ইষ্টিশান’। এখানে একটা রেলগাড়ি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। চড়ে বসলেই চলতে শুরু করবে ধোঁয়া উড়িয়ে। বইয়ে পড়া রেলগাড়ির সেই ঝিকঝিক শব্দ। রেলগাড়িতে চড়েই এবার যাব বাহিরপুরে।
এখানকার সবই তোমার পরিচিত, তবে ঠিক যেমন চাও সেভাবেই সাজানো। এটা সেই নগরজীবনই, তবে কাঠখোট্টা নয়। এখানে বিভিন্ন ঘরে তোমার সারা বেলাকে খুঁজে পাবে। সুপ্রভাত কক্ষে তোমার সাজানো বিছানা তো আছেই, আছে সকালবেলার পাখির ছবিও। তোমার বই, পুতুলের ঘর, আঁকিবুকির সরঞ্জাম আর তোমার ছোট্ট ঘর তৈরির ব্লক সবই আছে এখানে। তবে অন্য রকম কাজকম্মের (অ্যাক্টিভিটিস) ঘরটা। এখানে তোমার মুক্ত ক্যানভাস, ব্লক আর সবকিছুই এমনভাবে সাজানো, যেন যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে তুমি। সুপ্রভাত কক্ষের বিছানায় শুয়ে আলো-আঁধারির মধ্যে দেয়ালে তাকালে দেখবে আরেক স্বপ্নরাজ্য। নীল আকাশে পরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান থেকে শুরু করে ব্যাটম্যান পর্যন্ত তোমার স্বপ্নের সব নায়কই আছে এখানে।
লাল ফড়িং নামকরণ প্রসঙ্গে অটবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বির হাসান বললেন, ‘ছোটবেলায় ফড়িংয়ের পেছনে দৌড়েছি আমরা অনেকেই। কিন্তু লাল ফড়িং দেখলেই মাথা খারাপ হয়ে যেত। সৃষ্টিও সে রকমই। নতুন করে অন্য রকম কিছু একটার পিছু নেওয়া। আমরা চাই, শিশুরাও সেই লাল ফড়িংয়ের পিছু নিক। তার সৃষ্টিশীল মনটাকে ছুটে চলতে দিক। লাল ফড়িং ইষ্টিশানে তার নিজের সেই সৃষ্টির পেছনে দৌড়াতে শিখবে শিশুরা। এখনকার নগরশিশুদের অনেকেই গ্রাম দেখেনি। নদীর পাড়ে বসে পাখির ডাক শোনা তো দূরে থাক রেলগাড়ির ধোঁয়াও হয়তো দেখেনি তাদের অনেকেই। কিন্তু পাখিডাকা সেই বাংলাদেশই তার শেকড়, তার অন্তর। সেই শেকড়কে না চিনলে কিছুই হবে না এই শিশুদের দিয়ে। শিশুদের শেকড় চেনানোর জন্যই আমাদের হৃদয়পুরের এই স্বপ্নের ডালপালা। নগরজীবনে হয়তো তাকে সেই গ্রাম এনে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে যা সম্ভব তা হলো তার চারপাশটিকেই তার মতো করে সাজিয়ে দেওয়া। যেন সে অন্তত চিন্তা করার সুযোগ পায়। সেটাও দেখানে হয়েছে এখানে।’
লাল ফড়িং ইষ্টিশানের স্টেশনমাস্টার লিটন জানালেন, ‘এখানে শিশুরা এলে আর যেতে চায় না। আরও কিছুক্ষণ থাকার জন্য কান্নাকাটি করার ছবি প্রতিদিনকার।’ এই লাল ফড়িং ইষ্টিশান খোলা থাকে সপ্তাহের সাত দিন। আর এখানে আসার জন্য কোনো টাকা দিতে হয় না। এমনকি এখানে ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে অটবি থেকে আসবাব কেনারও কোনো সম্পর্ক নেই।
জাবেদ সুলতান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৬, ২০০৯
Leave a Reply