বসন্তে প্রকৃতি রঙিন হয়ে ওঠে। অন্যান্য ঋতুর তুলনায় বসন্তেই বেশি ফুল ফোটে। গত বসন্তেও লাল-হলুদে প্রকৃতি ছিল একাকার। ব্রাউনিয়া, কর্ডিয়া, পারিজাত, পলাশ, শিমুল, উদাল, মাদার, গ্লিরিসিডিয়াসহ লাল ঝুমকো লতার ছড়াছড়ি। এসব দেখে দেখে ক্যামেরা তো আর বন্ধ করে রাখা যায় না। চারপাশে ফুল আর ফুল। পথ চলার সর্বত্র একই দৃশ্য। রমনার নার্সারিতে একেবারে চোখ ধাঁধানো অবস্থা। এখানে প্যানজি, লুপিন স্মেপড্রাগন, পপি, ডায়ান্থাস, জারবারা, হুড়হুড়িতে মৌমাছি আর প্রজাপতির লুটোপুটি। এমনই একদিন হুড়হুড়ির ছবি তুলতে গিয়ে ঝোপঝাড়ের মতো পড়ে থাকা একটি ছোট গাছ চোখে পড়ল। গাছটি সাদা ফুল চমৎকার সৌরভের। বুনো গাছটাছ হবে ভেবে ফুলের ছবি তুলে চলে এলাম। এরপর থেকেই খোঁজাখুঁজি। এর মধ্যে দুই মাস গত হয়েছে। রুটিনমতোই একদিন বলধা বাগানে গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে বিচিত্র বকুলের কাছে বসে থমকে দাঁড়ালাম। যা খুঁজছিলাম তা-ই। রমনা নার্সারির সেই গাছটি এখানে পাশাপাশি দুটি। এখানে নিয়মিত যাতায়াত আমার, অথচ গাছ দুটি আমার দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেল, ভেবেই পেলাম না। তারপর খোঁজাখুঁজি আবার। এবার নাম জানলাম অলিয়া। তবে তখন পর্যন্ত অলিয়া সম্পর্কে কিছুই জানি না। এর মধ্যে একদিন রমনা উদ্যানে নিসর্গপ্রেমী ও উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক পরিবেশ সুরক্ষা ও সৌন্দর্যায়নের নিরলস কর্মী দ্বিজেন শর্মা-আমাদের প্রিয় দ্বিজেন দার সঙ্গে দেখা। ফুলটি সম্পর্কে বলতেই তিনি ছুটলেন আমাদের সঙ্গে। গাছটি যে দুষ্প্রাপ্য তা তিনি দেখেই বুঝলেন। তবে অলিয়া নামটি নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। আমারও খোঁজখুঁজি অব্যাহত ছিল। শেষে একদিন জানলাম, এ হলো ওসমান্থাস! চীন ও তাইওয়ানের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ফুল, যা কিনা আমাদের দেশে অত্যন্ত অবহেলা ও অযত্নে পড়ে আছে।
ওসমান্থাস ছোট্ট ক্রিম সাদা ফুল। চীন দেশ এর আদি বাসস্থান। ঐতিহ্যগতভাবে ফুলটি সেখানে রোমান্স, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের প্রতীক। এর উদ্ভিদ বিজ্ঞানীয় নাম হলো-Osmanthus fragrans, oleafragrans ও olea ovalis এর সম্পূরক নাম। Tea Olive ও Sweet olive নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। জাপানে kinmokassei নামে পরিচিত। পরিবার Oleaceae.
Osmanthus গ্রিক শব্দ।
সেখানে Osona হলো সুগন্ধ।
anthus ফুল। সুতরাং ফুলটির নামকরণের কারণ তার নামের সঙ্গেই প্রস্কুটিত। সুগন্ধি ফুল ওসমান্থাসের ঘ্রাণ অনেক দূর থেকেও আপনাকে টানবে। ফুল ফুটলে গন্ধে বাতাস ভরে ওঠে। ওসমান্থাসের গন্ধ অচেনা নয়, তবে ব্যতিক্রম। একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব, মিল খোঁজা, শেষে রহস্য ভেদ। ওসমান্থাসের সঙ্গে পাকা বেলের গন্ধের দারুণ মিল। উনিশ শতকের মধ্য ভাগে ফ্রান্সের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী Jean Maric Delavay প্রথম চীন দেশের বাইরে ওসমান্থাসের পরিচিতি তুলে ধরেন। তারপর থেকে ইউরোপেও এর জনপ্রিয়তা লক্ষ করার মতো।
ছোট গাছ ওসমান্থাস। উচ্চতা ছয়-সাত ফুটের মতো। Oleace পরিবারভুক্ত গাছগুলো বেশির ভাগই ধীরগতিতে বাড়ে। ওসমান্থাসও তার ব্যতিক্রম নয়। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও অলংকারিষ্ণু ওসমান্থাসের ডিম্বাকৃত গাঢ় সবুজ পাতার সঙ্গে চা ও ক্যামেলিয়ার চমৎকার মিল রয়েছে। শুধু মিল নয়, সবুজ ও কালো চায়ের সঙ্গে এর ব্যবহার চীনে ঐতিহ্যগত। সচরাচর আমরা যে চা খাই, তার সঙ্গে অথবা গ্রিন ও ব্লাক টির সঙ্গে অল্প পরিমাণ ওসমান্থাস ও জেসমিনের পাপড়ির মিশ্রণ একটি পাত্রে নিয়ে তা খুব ভালোভাবে মুখ বন্ধ করে রেখে দিতে হয় কয়েক সপ্তাহের জন্য। সেই চায়ের পরিবেশন বিশেষ দিন বা বিশেষ অনুষ্ঠানে। তা ছাড়া ওসমান্থাস ফুল দিয়ে নববধূকে বরণ করা চীনা রীতির অন্যতম একটি অংশ। সে জন্যই ওসমান্থাসকে বলা হয়-Arama of the Chinese Catture
সেপ্টেম্বর চীন দেশে ওসমান্থাসের সেরা সময়। সে সময় সেখানে চন্দ্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের মূল আকর্ষণ ওসমান্থাস ফুল। এই উৎসব চন্দ্র উৎসবের চেয়ে ওসমান্থাস উৎসব নামেই বেশি পরিচিত।
ফারুখ আহমেদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৬, ২০০৯
Leave a Reply