তিন বছর আগেও হতদরিদ্র মঞ্জু রানী অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। স্বামীও দিনমজুরি করতেন। পরিবারে ছিল অভাব-অনটন। সেই চিরাচরিত নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। এক বেলা খাবার জুটলে আরেক বেলা উপোস। এমনও দিন গেছে, দুই বেলাই উপোস। মঞ্জু রানীর এই কষ্ট এখন আর নেই। নিজেই বদলে ফেলেছেন। মঞ্জু রানী এখন একা নন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখন অনেক রানী গ্রামে কাঁথা তৈরির কাজ করছেন। পরিবর্তন এসেছে অভাবনীয়। করছেন আয়। সেই কাঁথা নিয়ে উড়োজাহাজে উড়ে মঞ্জু রানী ভারতে দিল্লির হস্তশিল্প মেলায় গেছেন। নিজেদের ভাগ্যের চাকা পাল্টে ফেলছেন তাঁরা। রংপুরের অজপাড়াগাঁয় রানী নামের নারীদের নিপুণ হাতের কাজ করা কাঁথা এখন বিদেশের বাজারে। এই কাঁথার নাম হলো লহরী অর্থাৎ ঢেউ কাঁথা।
অন্ধকারে আলোর নাচন
রংপুর সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর ইউনিয়ন। শহর থেকে মাত্র সাত-আট কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম। এখনো অজপাড়াগাঁই থেকে গেছে। কোথাও বিদ্যুতের আলো পৌঁছেছে আবার কোথাও আলো নেই। মানে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। আলোর নাচন নেই তাতে কী হয়েছে? আলোর সন্ধানে নিজেকে বদলাতে তাঁরা অবিরাম কাজ করছেন। দিনবদলের গান গাইছেন গ্রামের নারীরা।
২০০৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে রাজেন্দ্রপুর গ্রামে এই কাঁথা তৈরির কাজ শুরু হয় ‘রাজেন্দ্রপুর সামাজিক উন্নয়ন সংগঠন’ নামে। একসময় এই সংগঠনের গ্রামের নারীরা নানামুখী সামাজিক কাজ করতেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করা, পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো, বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন রোধ। এসব সামাজিক কাজে গ্রামের নারীদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। ঠিক এমন এক অবস্থায় তাঁরা তাঁদের নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ওই সংগঠনের নারীরাই প্রতিষ্ঠা করেন ‘নিজেরা কটেজ অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রি’। এই সমিতির সদস্য ১০৬ জন। সমিতির মাধ্যমে ওই গ্রামে ৩০ শতাংশ জমিও কেনা হয়েছে। এখন তাঁদের উপার্জিত আয় দিয়েই এই সমিতি সাফল্য অর্জন করে চলেছে। এসব কাজে প্রথমে আর্থিক সহায়তা দেয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ।
গ্রামের নারীদের এই কাজের পেছনে উৎসাহ দিতে যিনি কাজ করেছেন, সেই কেয়ার বাংলাদেশ সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের হতদরিদ্র মহিলারা যেন নিজেই স্বাবলম্বী হতে পারে, এজন্য তাঁদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের তৈরি কাঁথা, শাল ও চাদর এখন বিদেশের বাজারে। এই শিল্পের পুরো অর্থের মালিক ওই কাজের সঙ্গে জড়িত গ্রামের নারীরাই। বর্তমানে আট সদস্যের একটি পরিচালকমণ্ডলী রয়েছে। পরিচালক জুলেখা বেগম বলেন, উপার্জিত টাকা সমিতির মাধ্যমে ব্যাংকে জমা হয়। লভ্যাংশ সবার মধ্যে বণ্টন করা হয়। এই কাঁথার কাজ বর্তমানে রাজেন্দ্রপুর ছাড়িয়ে মাস্টারপাড়া, ধনিরপাড়া, মস্তাপুরপাড়া, বাসন্তীপাড়া, কানপাড়া, গোয়ালপাড়াসহ সেখানকার পার্শ্ববর্তী ১৮টি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।
জানা যায়, একটি কাঁথা তৈরিতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ দিন। উপকরণ হিসেবে যা যা প্রয়োজন, এসব তাঁরা এই সমিতির মাধ্যমে সরবরাহ করে থাকেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাপড়, সুঁই-সুতা, নীল রংসহ অন্যান্য উপকরণ। নারীরা তাঁদের নিজ বাড়িতে বসে কাজের ফাঁকে এই কাঁথা তৈরি করেন। বাড়ির অন্যান্য কাজের সঙ্গেও এই কাজ করতে তাঁদের তেমন একটা অসুবিধা হয় না বলে কর্মরত নারীরা জানালেন।
এ যেন অনেক রানী···
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। ছোট্ট একটি গ্রামে যেন অনেক রানীর জন্ম। এই কাঁথা তৈরিতে যেসব নারী কাজ করছেন, তাঁদের অধিকাংশের নামের শেষে রয়েছে রানী শব্দ। এঁরা সবাই একই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা। একসঙ্গে করছেন কাঁথা তৈরির কাজ।
মস্তাপুরপাড়ার মঞ্জু রানীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি আপন মনে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করছেন। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারের অভাব-অনটন দূর করতে একসময় অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হতো। কষ্ট পেতে পেতে এখন বুদ্ধি খুলে গেছে তাঁর। উৎপাদিত কাঁথা নিয়ে তিনি দিল্লির হস্তশিল্প মেলায় গেছেন। এই মেলার অনুভূতি জানতে চাইলে বলে ওঠেন, “যারা মাল কেনে হামার অ্যাটে তামাক ক্রেতা কয়। কিন্তু দিল্লির মেলাত শুননো ওমরা ‘বায়ার’।” অভাবের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি আরও বললেন, শুধু না খেয়ে থাকাই নয়, পরনের কাপড়ও ছিল ছেঁড়ে-ফাটা। পরনের শাড়ি গোসল করে পরনেই শুকিয়েছেন। এখন তিনি দুই ছেলেমেয়েকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে পড়াচ্ছেন।
একই গ্রামের নমিতা রানীর স্বামী মারা গেছেন। টানাপড়েনের সংসারে নমিতাও আড়াই বছর আগে দিনমজুরির কাজ করতেন। এখন তাঁকে ওই কাজ করতে হয় না। দুই ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। কাঁথা বানানোর উপার্জিত টাকা দিয়ে কিছু জমি বন্ধক নিয়েছেন তিনি। বাড়ির আঙিনায় কাজ করতে করতে বললেন, ‘কাঁথায় হামার পরিবর্তন আনিল। বর্গা (বন্ধক) নেওয়া জমিতে ধান ফলাচ্ছি। আবাদ করছি নানা ধরনের সবজি। এখন আর অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হয় না। নেই অভাব-অনটন।’ কেমন আয় হয়? কথা প্রসঙ্গে বললেন, একেক মাসে একেক রকম। গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় তো হয়ই।
বাসন্তীপাড়া গ্রামের জ্যোৎস্মা রানীর ছিল অন্ধকার জীবন। বর্তমানে কাঁথা তৈরির কাজ করে মাসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা আয় করছেন। নিজের পরিবারে জ্যোৎস্মার আলো তো ছড়িয়েছেন ঠিকই। তাঁর বাড়িতে কাঁথা সেলাই করার সময় দেখা যায়, আঙিনায় পলিথিন বিছিয়ে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করছেন। জ্যোৎস্মা যেন জ্যোৎস্মার আলো ছড়িয়ে আলোকিত করার চেষ্টা করছেন গ্রামের অন্য নারীদের। জ্যোৎস্মা বললেন, ‘কাঁথা বানিয়ে এই কাঁথা ব্যবহার করতে পারি না ঠিকই। কিন্তু আগের চেয়ে কত যে ভালো আছি! দুই বছর আগে থেকে এই কাঁথার কাজ করছি। কিছু টাকাও আয় হচ্ছে। জমি বন্ধক নিয়ে নিজেই আবাদ করছি সেই জমি। আগে এর-ওর কাছে হাত পাততে হতো। কাজকাম করে ওই টাকা শোধ করতে হয়েছে। এখন তা আর করতে হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিজেরা নিজেদের জীবন পাল্টানোর কাজ করছি বলেই এখন আমাদের গর্ব হয়।’
একই গ্রামের নির্মলা রানীর পরিবারেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। অল্প কিছুদিন আগেও উপোস থাকতে হতো। ক্ষুধা পেটে লাজলজ্জায় কারও কাছ থেকে কর্জ করতেন বলে জানালেন। এখন তাঁর গর্ব হয়। বললেন, ‘নীল গাছের পাতা দিয়ে নীল রং তৈরি করছি। আর সেই নীল রং দিয়ে তৈরি করছি কাঁথা। মাসে আয় হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।’
গোয়ালপাড়া গ্রামের আরতি রানীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করছেন। দুটি শিশু পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে। তিনি বলেন, নীল গাছের পাতা সংগ্রহ করে নিজেরাই নীল রং করছি। সেই রং কাঁথায় লাগানো হয়। এ ছাড়া প্রভাতী রানী, দুলালী রানী, বাচ্চা রানী, শেফালী রানী, আরতি রানী, যমুনা রানী, শোভা রানী, সু্নিতা রানী, সুধা রানী, ছায়া রানীসহ অনেক রানীর গল্পও যেন একই সুতোয় গাঁথা। গ্রামের একজন ভুলু মিয়া বলেন, স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তিন বছর আগে একটিমাত্র কুঁড়েঘরে কষ্ট করে বসবাস করতে হয়েছে। সে অভাব এখন আর নেই। দুটি দোচালা টিনের ঘর হয়েছে। কাঁথাশিল্পের সঙ্গে তাঁরও স্ত্রী কাজ করছেন। আয়ের টাকা দিয়ে কিছু জমি বন্ধক নেওয়া হয়েছে। সেই জমিতে তিনি আবাদের কাজ নিজেই করছেন বলে জানালেন। জমির ধান ও স্ত্রীর কাঁথা তৈরি থেকে প্রতি মাসে গড়ে আয় হয়ে থাকে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এখন মেয়েকে অনার্স পড়াচ্ছেন ভুলু মিয়া।
সেই দিন এবং এই দিন
এই কাঁথা তৈরিতে একটিমাত্র রং ব্যবহার করা হয়। আর তা হলো নীল রং। নীল রং আবার তাঁরা নিজেরাই তৈরি করছেন। এই নীল সেই নীল। যে নীল চাষ নিয়ে একসময় নীলকরদের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের।
নীলগাছ রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে চাষ হয়ে থাকে। চাষিরা এই গাছ জমির আইল, জমি এবং সড়কের দুই ধারে লাগিয়ে থাকে। এই গাছের পাতা জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অনেক বছর ধরে। এই গাছ চাষ করতে তেমন একটা খরচ পড়ে না। বর্ষাকালের পানি পেলে এমনিতেই বড় হয়ে ওঠে।
কালো মেঘে রুপালি রেখা···
দিল্লির মেলায় মন্তব্য বইয়ে মেলায় আগত বিশিষ্টজন এই কাঁথার ভূয়সী প্রশংসা করে মন্তব্য করেছেন। এঁদের মধ্যে বিশিষ্ট লেখক অরুন্ধতী রায় মন্তব্য বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি নিজেকে মুড়িয়ে মূল্যবান করে ফেলব।’ বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার রাজীব শেঠি লিখেছেন, ‘কালো ভারতীয় মেঘে এ যেন এক রুপালি রেখা।’ ডিজাইনার নিরু কুমার লিখেছেন, ‘চমৎকার এক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে চমৎকার এক কাজ।’ আরেক ফ্যাশন ডিজাইনার জাসজিৎ বাগ মন্তব্য করেছেন, ‘অনেক দিন পর আমি কিছু ভালো কাজ দেখলাম-সৎ ও চমৎকার।’ ভারতে দিল্লির হস্তশিল্প মেলায় একেকটি কাঁথা বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার এবং সর্বনি্ন আট হাজার টাকায়। সেখানে কাঁথা বিক্রি হয়েছে দুই শতাধিক।
দিল্লির মেলায় তাঁদের উৎপাদিত কাঁথা নিয়ে এখান থেকে ছয়জন যান। এর মধ্যে তিনজন ওই গ্রামেরই নারী। মঞ্জু রানী ছাড়াও রশিদা বেগম ও মমতাজ বেগম ছিলেন। ভারতের দস্তকার নামের নামকরা একটি হস্তজাত শিল্পের সংগঠনের আমন্ত্রণে তাঁরা এই মেলায় অংশ নেন। হস্তজাত শিল্পের সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক হলেন লায়লা তৈয়বজি। সেখানে ১৫ দিনব্যাপী এই মেলা চলে। দিল্লির মেলার স্থানের নাম হলো দিল্লির হাট। ২০০৮ সালের ১৫ নভেম্বর এই মেলা শুরু হয়।
আরিফুল হক, রংপুর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২০, ২০০৯
Leave a Reply