পথে পথে বাধা-বিপত্তি পার করতে হয় আমাদের সমাজের মেয়েদের। যেমন, যাতায়াতে মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে। এমনকি চলার কষ্ট তো আছেই, পুরুষদের দ্বারা হয়রানি হতে হয় যখন তখন। আর ঢাকা শহরের তো কথাই না, তেমনি কয়েকজনের মুখোমুখি হলাম-
১·
ফারজানা রহমান। ইডেন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মায়ের হাত ধরেই স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার কাজ সেরেছেন। তখন হয়তো সমস্যায় পড়েছেন, আর মাকেই তা সমাধান করতে হয়েছে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পার করার পর তিনি টের পেয়েছেন নারীসমাজ কতটা অবহেলিত। সকাল নয়টা ৪৫ মিনিটে তাঁর ক্লাস শুরু। মিরপুর-১ নম্বরে তাঁর বাসা। বাস পেতে দেরি, রাস্তায় যানজট-সব মিলে তাঁকে বাসা থেকে নামতে হয় সাড়ে আটটায়। বাসের জন্য বিরাট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, নেই কোনো যাত্রী ছাউনি, নেই কোনো পাবলিক টয়লেট। আর পাবলিক টয়লেট থাকলে নেই মেয়েদের জন্য সুব্যবস্থা। ফলে মেয়েরা কোনো শারীরিক জটিলতায় পড়লে যাত্রাপথে সহ্য করা অথবা যাত্রা বাতিল করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ফারজানার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম কিছুই ঘটেনি।
২·
সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ শেষ করে একটি বিদেশি ফার্মে চাকরিতে ঢুকেছেন মেয়েটি। সন্ধ্যা সাতটায় তাঁর অফিস শেষ হয়। অফিস থেকে বের হয়ে বাসে উঠতে উঠতে সাড়ে সাতটা বাজে। টিকিট কেটে বাসে ওঠার আগে অসৌজন্যমূলক আচরণ তো পেতেই হয়। আর সন্ধ্যায় বাসে উঠলে যে ঘটনা ঘটে, তা অবর্ণনীয়। বাস চলার আগে লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়। এটা হয়তো যৌক্তিক। ওরা কারণ দেখায়, চালকের গ্লাস দেখতে অসুবিধা হয়। কিন্তু এ সুযোগটা পেয়ে বসে বাসের যাত্রী থেকে শুরু করে কন্ডাক্টর পর্যন্ত। প্রতিদিনই আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয় কারও না কারও দ্বারা। আমি থেমে থাকার নই, প্রতিবাদ করে উঠি। উল্টো আমাকেই কথা শোনায়, এত সমস্যা থাকলে মেয়েরা সন্ধ্যার পরে বাসে উঠবে না। তাহলে কি চাকরি ছেড়ে দেব? সেটা আমি করব না। আমি লড়ব, শেষ পর্যন্ত লড়ব। আমাকে দাঁড়াতেই হবে।
৩·
মাহমুদা মাহবুব। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রী। বাসা যাত্রাবাড়ী। ক্লাস শুরু হয় নয়টায়। ক্লাসে আসার জন্য তাকে বাসা থেকে নামতে হয় আটটায়। বাসে ওঠানামা নিয়ে তাকে তো হয়রানি হতেই হয়, বাসের মধ্যে সম্মুখীন হতে হয় বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতির। কটূক্তি উভয়ের শিকার হয় পদে পদে। মাহমুদার মতে, দাঁড়িয়ে পুরুষ দ্বারা লাঞ্ছিত তো হই, আবার বাসে উঠতে পুরুষেরাই বলে, ‘এই, মহিলা তুলবি না।’ শুনে যে কষ্ট, যে লজ্জা পাই-মাঝেমধ্যে মনে হয় পড়াশোনা ছেড়ে দিই। কিন্তু আবার মনে হয় পিছিয়ে আমিই পড়ব, ওরা নয়।
৪·
আশরাফী সুলতানা। গুলশানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন। বাসা উত্তরা। সরাসরি বাসের ভাড়া বেশি। তাই তাঁকে লোকাল বাসে আসা-যাওয়া করতে হয়। লোকাল বাসের আসন সীমিত। তাই প্রতিদিনই একটি কথা তার শুনতে হয়, ‘লেডিস ওঠানো যাবে না।’ দাঁড়িয়ে যাব, দেরি হয়ে যাচ্ছে-এসব কৈফতে কোনো কাজ হয় না। তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় ফাঁকা বাসের জন্য। অথচ তাঁর সামনে থেকে হাজারো পুরুষ বাসে ওঠে যাচ্ছে, তাতে কোনো বাধা নেই। ফাঁকা বাস পেলেও সেটায় উঠে বসার পর বাস ভরার জন্য অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকে। এ জন্য অফিসের সময় পার করে অফিসে ঢুকতে হয় নতুবা বাসা থেকে বের হতে হয় সাতটার আগে। সকালে উঠে পত্রিকায় চোখ বোলানো, সকালের নাশতা খাওয়া অথবা অসুস্থ মাকে কাজে সাহায্য করা-কোনোটাই হয়ে ওঠে না তাঁর, পিছিয়ে যান তিনি। এভাবে পিছিয়ে যান ঢাকা শহরের অনেক নারী।
এ ছাড়া মাতৃত্বকালীন ছুটি মাত্র চার মাস। সব প্রতিষ্ঠান মানেও না। কাজেই একজন কর্মজীবী গর্ভবতী মহিলার বাকি সময়টা কর্মস্থলে আসা-যাওয়ায় অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। এ রকম অনেক উদাহরণ পাওয়া গেছে, যাঁরা চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে শারীরিক জটিলতায় পড়েছেন। তাই চাই যাতায়াতে মেয়েদের জন্য, হবু মায়েদের জন্য সুব্যবস্থা। কারণ থামলে তো চলবে না। এগিয়ে যেতেই হবে সামনে।
লায়লা নূর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২০, ২০০৯
Leave a Reply