সাতক্ষীরার মেয়ে রিতা উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। রিতার বাবা দরিদ্র কৃষক। পাঁচ ভাইবোনের সংসারে রিতাই বড়। রিতার বাবার সাধ্য নেই তাঁর পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ বাবদ মাসে মাসে টাকা পাঠানোর। বাধ্য হয়ে রিতার নিজেকেই খরচ চালানোর উপায় বের করে নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজলভ্য উপায় মোটামুটি একটাই, টিউশনি।
টিউশনি করতে গিয়ে রিতাকে প্রায়ই বিভিন্ন বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। সহ্য করতে হয় নানা অপমানও। উপায়হীন বলে রিতার কিছুই করার থাকে না। টিউশনির টাকা দিয়েই তাঁকে নিজে চলতে হয় এবং এ থেকে বাসায়ও কিছু পাঠাতে হয়। রিতার মতো বহু মেয়েকেই টিউশনি করতে গিয়ে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। শিকার হতে হয় নানা লাঞ্ছনা ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির। নীরবে এসব সহ্য করে কেউ কেউ হয়তো সরে আসে, আবার অনেকেই তা চালিয়ে যেতে বাধ্য হয় প্রয়োজনেই।
কেস স্টাডি-১
নীলিমা (ছদ্মনাম) ইডেন কলেজের অর্থনীতির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাঁর বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নীলিমা তাই টিউশনি করে নিজের হাতখরচ চালিয়ে নেন। তিনি পড়ান মোহাম্মদপুরের এক বাসায় দশম শ্রেণীর একটি ছেলেকে। সপ্তাহে পাঁচ দিন পড়াতে হয়। প্রথম দিনই ছাত্রের মা নীলিমাকে পড়ানোর ব্যাপারে নানা রকম শর্ত আরোপ করে দেন। এ ছাড়া তিনি সন্দেহও করেন, মেয়েমানুষ শক্তভাবে পড়াতে পারবেন কি না। সে ক্ষেত্রে নীলিমা প্রথম থেকেই খুব সতর্কতার সঙ্গে পড়াতেন। তবু ভদ্রমহিলার নানা রকম অপ্রীতিকর মন্তব্য থেকে রেহাই পেতেন না। একদিন নীলিমা পড়াচ্ছেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পান, বাড়ির ভেতরে ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে বলছেন, ‘এই মেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়ায়। এদের স্বভাবচরিত্র তো খারাপ হবেই। এটা তো জানা কথা।’ এ কথা শোনার পরের মাস থেকেই নীলিমা টিউশনি ছেড়ে দেন। পরের দুই মাস নতুন টিউশনি জোগাড় করতে না পারায় তাঁকে খুব কষ্ট করে চলতে হয়েছে।
বললেন নীলিমা, ‘এসব তো আলোচনা করা যায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে টিউশনি করতে গিয়ে এমন কিছু অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়, যা কারও কাছেই বলা যায় না। আমারই এক বান্ধবী খিলগাঁওয়ের এক বাসায় পড়াত। ঘটনাক্রমে একদিন সেই বাসায় ছাত্র বা তার মা-বাবা কেউ ছিলেন না। দরজা খুলে দিয়েছিল ছাত্রের দূরসম্পর্কের এক মামা। কিন্তু সে বলেনি বাসায় কেউ নেই। ও বাসায় ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওকে জোরপূর্বক নির্যাতন করে। চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করলে মারধর করে ওর মুখ বেঁধে ফেলে। এরপর ওকে ভয় দেখায়, যদি এ কথা ও কাউকে বলে তাহলে ওর ভীষণ ক্ষতি করবে। লজ্জায়, অপমানে, ভয়ে এ কথা ও কাউকেই বলতে পারেনি। এ ঘটনার পর থেকে হাসিখুশি এই মেয়েটি যেন কেমন হয়ে যায়। পড়াশোনাতেও খারাপ করতে থাকে।’
কেস স্টাডি-২
‘কিছু কিছু ঘটনা যে মেয়েরা শক্ত হাতে প্রতিরোধ করে না তা কিন্তু নয়।’ বললেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী নবনী (ছদ্মনাম)। ‘আমাকেই একদিন এ ধরনের বিব্রতকর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একদিন দেখি ছাত্র ও তার মা বাইরে। বাসায় শুধু ছাত্রের বাবা। ছাত্র এখনি চলে আসবে, তাই আমাকে বসতে বলে নানা রকম কথাবার্তার একপর্যায়ে সেই লোক আমাকে জড়িয়ে ধরতে আসে। আমি সজোরে তার গালে একটা চড় মেরে সেখান থেকে দ্রুত চলে আসি। পরের দিন না যাওয়ায় ছাত্রের মা যখন ফোনে জানতে চান কেন যাচ্ছি না, তখন আমি তাঁর স্বামীর ঘটনা বলে দেই। আসলে আমাদের সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের জন্য কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। সে ক্ষেত্রে মেয়েদেরই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’
কেস স্টাডি-৩
মিডিয়া সেন্টারের মাধ্যমে টিউশনি পেতে গিয়ে মেয়েরা শিকার হচ্ছে নানা রকম হয়রানির। একটি মিডিয়া সেন্টার সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা জানালেন ইসরাত (ছদ্মনাম)। ‘বিজ্ঞাপন দেখে আমি প্রথমে যোগাযোগ করলে তারা সদস্য ফি হিসেবে ২০০ টাকা রাখে। এরপর তারা যে বাসায় টিউশনি ঠিক করেছে সেখানে গিয়ে কথা বলে আসতে বলে। আমি আমার এক বান্ধবীকে নিয়ে সেখানে গিয়ে সেই লোককে ফোন দিলে সে আমাকে সরাসরি ফ্ল্যাটে ঢুকতে বলে। সন্দেহ হওয়ায় আমি অন্য এক লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, কোনো পরিবার নয়, সেই ফ্ল্যাটে ব্যাচেলররা থাকে। পরে সদস্য ফির টাকা ফেরত চাইলে সেটাও দিতে তারা অস্বীকার করে। শুধু যে টিউশনি করার সময় সমস্যায় পড়তে হয় তা নয়। টিউশনি থেকে ফেরার পথে রাস্তাঘাটেও নানা রকম ঝামেলায় পড়তে হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী ফারজানা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘যেহেতু আমি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী, তাই আমার সকালে ক্লাস আর দুপুরে ল্যাব থাকায় বিকেলে টিউশনি করতে হয়। প্রায়ই আমার আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। একা একা আসার পথে রাস্তায় বখাটেদের আজেবাজে মন্তব্য শুনতে হয়। সে জন্য তাড়াতাড়ি হলে ফিরতে চেষ্টা করি।’ টিউশনি করতে গিয়ে সব সময় যে খারাপ অভিজ্ঞতা হয় তা নয়। পরিচিতির মধ্যে টিউশনি করলে সাধারণত তেমন অসুবিধা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্রী রিমি বললেন, ‘আমার ছাত্রীটি আমার এক বন্ধুর ছোট বোন। ছাত্রীর মা তাই আমাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। আমার পড়াশোনার খোঁজখবর নেন।’
রওশন আরা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২০, ২০০৯
sagra
how are u I AM SRGRA CALL ME
sagra
I LOVE ME U