একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে দেখলেন, উঠোনের পাশে ঘাস-জমিনের ওপর লাল লাল ফুল পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখলেন, অনেক পলাশ ফুল পড়ে আছে গাছের তলায়। পুষ্প-পত্রহীন কৃষ্ণ পলাশ গাছটা তো কদিন আগেও ন্যাড়া ছিল। হঠাৎ ফুল এল কোত্থেকে? ওপরে তাকিয়ে দেখলেন, দু-একটি পাতা আছে কি নেই, ঠাসাঠাসি করে ডালপালা ফুঁড়ে ফুলগুলো বেরোতে চাইছে। রক্তলাল আগুনের শিখার মতো জ্বলজ্বল করছে ফুলগুলো। ডালে বসে আছে শালিক পাখি। হঠাৎ কানে এল কোকিলের ডাক। কোথায় ডাকছে? চোখ তুলে তাকাতেই দেখলেন, বাড়ির বেড়ার কাছে যে শিমুল গাছটা, ওর ডালে বসে রয়েছে পাখিটা। লাল-কমলা শিমুল ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে ডালটা। আর তার ওপর বসে কোকিলটা ডাকছে। ফিরে এসে পুকুরঘাটে গিয়ে দেখলেন, ঘাটের দুই পাশে দুটো দেবকাঞ্চনের গাছ। গাছ দুটোতে যেন প্রজাপতির মেলা বসেছে। না, সত্যি প্রজাপতি নয়। প্রজাপতির মতো লাল-গোলাপি অজস্র ফুলে ভরে আছে দেবকাঞ্চনের গাছ। পাতাহীন। কিন্তু ফুল তার সব ডাল ঢেকে রেখেছে।
এখন বলুন তো, ফাগুন এসেছে কি না? নিশ্চয়ই এখন আর তা বোঝার জন্য ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টানোর দরকার নেই। এসব দখে মনে হতে পারে, ‘পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে, এসেছে ফাগুন মাস।’ গানের কী দোষ? ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুন। ফাল্গুন হলো রঙের মাস। প্রকৃতিতে লাগে রং। আর মনে লাগবে না? পলাশ, শিমুল, রক্তকাঞ্চন, রজতকান্তি বা গাউডিচাউডি, লোহিতাভ বা ব্রাউনিয়া, কনকলতা বা গোল্ডেন শাওয়ার, অশোক, পারিজাত বা পালিত মাদার, বিগ্নোনিয়া ইত্যাদি ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। তাই এ মাসের কিছু ফুল অন্তত চিনে নেওয়া যায়। তবে ভালো হয়, যদি আপনি আপনার পছন্দমতো কয়েকটি গাছ বাড়িতে লাগিয়ে ফোটাতে পারেন ফাগুনের ফুল।
শিমুলঃ শিমুলের জন্ম হয়েছিল মালয়েশিয়ায়। কিন্তু ও এখন আমাদের গাছই হয়ে উঠেছে। এ দেশের কোথায় নেই শিমুলগাছ? কাঁটাওয়ালা বৃক্ষ প্রকৃতির এ গাছটির কদর আমাদের দেশে তাই বলে ফুলের জন্য নয়, শিমুল তুলার জন্য। এ জন্য গাছটির ইংরেজি নাম জপন ঢ়মলর ধসয়য়সষ য়ড়পপ, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ইসশদথ িধপমদথ, পরিবার ইসশদথধথধপথপ. কিন্তু এই শিমুল গাছই এখন বসন্তের প্রতীক হয়ে উঠেছে। শীতে গাছের সব পাতা ঝরে যায়, ফাগুন এলেই পাতাবিহীন শাখা-প্রশাখায় ফুল ফুটতে শুরু করে। ফুলের রং লাল থেকে হলুদ। বড় আকারের কাপের মতো সাজানো থাকে পুরু পুরু পাপড়ি আর মাঝখানে থাকে ঝাঁটার মতো অসংখ্য পুরুষ কেশর ও স্ত্রী কেশর। ফুল খুব চমৎকার দেখায়। বীজ থেকে চারা হয়। তবে ডাল কেটে লাগালে তাতে দ্রুত ফুল ফোটে। ছোট ছোট গাছে থোকা ধরা ফুল দেখতে ভালো লাগে। ফুল ফোটে ফেব্রুয়ারি মাসে। ফল পাকে মে-জুন মাসে। তবে বীজের চারা লাগালে গাছ দ্রুত বাড়ে, প্রথম বছরেই প্রায় দুই মিটার লম্বা হয়ে যায়। বড় উদ্যান ও রাজপথ ছাড়া মানায় না। কেন না, শিমুলগাছ অনেক বড় হয়। শিমুলের অন্য নাম মাদার।
পারিজাতঃ বেশ কয়েক জাতের পারিজাত আছে এ দেশে। নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া জানালেন তাঁর প্রকৃতি পাঠের শুরু একটা সাদা রঙের পারিজাত ফুল দিয়েই। তবে সাদা পারিজাত এখন আর এ দেশে চোখে পড়ে না। সচরাচর লাল রঙের ফুলই চোখে পড়ে। শুকনো জায়গায় উঁচু জমিতে প্রায় সব গ্রামেই দেখা যায় যে পারিজাত, তাকে পালিতা মাদার বলেই সবাই চেনে। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ঊড়ীয়ভড়মষথ মষনমধথ· আর একটি পারিজাত জন্মে উপকূলে বা নিচু জলাশয় জায়গায়। এর নাম পানিয়া মাদার, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ঊড়ীয়ভড়মষথ ফৎঢ়ধথ· উভয় ফুলের রংই লাল। তবে পালিত মাদারের ফুল লম্বা লম্বা, পাকা মরিচের মতো, থোকা ধরে ফোটে। পানিয়া মাদারের ফুল মটরশুঁটির মতো। তবে মটরশুঁটি ফুলের চেয়ে অনেক বড়। কাঠ নরম, কাণ্ডের বাকল সবুজাভ ধূসর ও কাঁটাময়, দ্রুত বর্ধনশীল। তিনটি অনুপত্র মিলে একটি পাতা। প্রতিটি প্রায় ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৮-১২ সেন্টিমিটার চওড়া। ফল মটরশুঁটি ফল বা শিমের মতো, কিছুটা চোঙাকৃতি, বাদামি রঙের। পারিজাতগাছ দাঁড়ানো বা বদ্ধ পানি সইতে পারে না। ডাল কেটে পুঁতে দিলেই সহজে বেঁচে যায়। এ জন্য পারিজাতের ডাল কেটে বাগান বা বাড়ির সীমানা ঘেরা হয়। তবে বেশি বাঁচানোর জন্য বর্ষাকালের পরপরই এর ডাল লাগাতে হবে। বর্ষায় ডালে শিকড় না গজিয়ে তা পচে যেতে পারে। তবে বীজ থেকে চারা তৈরি করা সহজ। শীতকালে পারিজাতের সব পাতা ঝরে যায়। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফুল ফোটে। পারিজাত শুধু এ দেশে নয়, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে ভালোভাবে জন্মে থাকে। বীজ দিয়ে গাছটির নতুন চারা তৈরি করা যায়। তবে ডাল কেটে বর্ষার সময় লাগালে সহজে নতুন গাছ হয়ে যায়।
পলাশঃ ‘···আগুন লেগেছে বনে বনে।’ কথাগুলো কানে এলে তক্ষুনি চোখ দেখার জন্য পাগল হয়ে ওঠে পলাশকে। রৌদ্রতপ্ত দিনের আলোয় পাতাহীন পলাশের গাছে অজস্র ফুলের সমারোহ, এ যেন সত্যি এক অবাক করা দৃশ্য। জীবন্ত গাছে যেন আগুনের উৎসব। লেলিহান আগুনের শিখায় আলোকিত চারদিক। আর সে জন্যই বোধকরি ফুলপ্রেমীরা বাংলার পলাশকে ডেকেছেন ঋলথশপ সফ য়ভপ ফসড়পঢ়য় নামে, যার বাংলা অর্থ অরণ্যে অগ্নিশিখা। আর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ইৎয়পথ শসষসঢ়হপড়শথ, পরিবার খমবৎশমষসঢ়থপ· পলাশ শুধু এ কালে নয়, সুপ্রাচীনকালেও ছিল সমান আদরণীয়। মহাভারতের সভাপর্বে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে উদ্যান আর কৃত্রিম জলাধারের পাশেও ছিল পলাশ বৃক্ষের মাতামাতি। এমনকি দুই হাজারের বেশি বছর আগে লেখা কালিদাসের সংস্কৃত নাটক শকুন্তলায় বর্ণিত প্রমোদ উদ্যানে পলাশের উপস্থিতি রয়েছে।
পলাশ মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ। গাছ খুব কষ্টসহিষ্ণু। শুকনো মাটিতে বিনা যত্নে রেখে দিলেও সে বেঁচে থাকে। তবে বাগানের এক কোণে একে যত্ন করে লাগালে ফুল দেয় বেশি করে। মার্চ মাসে গাছের সব পাতা ঝরে যায় আর তক্ষুনি কুঁড়ি আসতে শুরু করে পলাশের। ফুলের কুঁড়িগুলো রক্তিম, দেখতে বাঘের নখের মতো, নস্যি রঙের মখমলের বৃতিতে ঢাকা থাকে গোড়া। ফুল ফোটে, থোকা ধরে। জাতভেদে পলাশ ফুলের রং লাল, কমলা, হলুদ ও সাদা হতে পারে। পলাশের কাঠ নরম। পলাশের বীজ থেকেই চারা হয়। পলাশ একেবারেই আমাদের দেশের গাছ। বর্ষাকালের শুরুতে পলাশের চারা লাগানো ভালো। তবে গাছটি শুধু বাগানে নয়, শৌখিন অনেকেই এখন পলাশের বনসাই করছেন। ছোট্ট টবে বামুন গাছে ঝাঁকড়া মাথাভরা পলাশের ফুল-ভাবুন তো কেমন সুন্দর!
কাঞ্চনঃ ফুলে ফুলে কাঞ্চনের গাছ যখন ভরে থাকে, তখন মনে হয় রঙিন প্রজাপতিরা ঝাঁক বেঁধে বসে আছে গাছটির ওপর। লাল, লালের ভেতর সাদা মেশানো অথবা সাদা ফুলগুলো হাওয়ায় দোল খেতে খেতে গাছটির চূড়া ঘিরে গড়ে তোলে এক স্বপ্নের পদাবলি। বর্ষা থেকে শীতের মাঝামাঝি পর্যন্তই কেবল এ রকম একটি ছবি কাঞ্চনগাছকে ঘিরে সম্ভব। শ্বেতকাঞ্চন ফোটে বর্ষা ও শরতে। কিন্তু ফাগুনে ফোটে রক্তকাঞ্চনের ফুল। তবে সারা বছরই দু-চারটি ফুল উটের খুরের মতো ধূসর-সবুজ পাতার ফাঁকে ফুটে উঁকি দেয়। পাতার এরূপ গড়নের জন্য কাঞ্চনের ইংরেজি নাম ক্যামেলস ফুট ট্রি। তবে বসন্ত এলেই গাছের পাতা সব ঝরে যায়। সে আরেক দৃশ্য। গাছটাকে তাতে মোটেই ন্যাড়া মনে হয় না, বরং গোটা গাছটাই তখন ফুলে ভরে যায়। বাগানের এ কোণে বা ও কোণে এ রকম দু-একটি কাঞ্চনগাছ থাকলে সত্যি তখন বোঝা যায়, বসন্ত এসেছে দুয়ারে। দূর থেকে দেখলে অপূর্ব দেখায়। বীজ থেকে বা ডাল কেটে নতুন গাছ তৈরি করা যায়। গাছটি বাঁচে অনেক বছর। তাই সুন্দরের স্রোতও বয়ে চলে বসন্তের পর বসন্ত ধরে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১০, ২০০৯
Leave a Reply