নাজমা পারভিন (৪০), আছিয়া (৫০), হেলেনা খানম (১৮), রেহানা খানমের (১৯) মতো গোপালগঞ্জ-২ (গোপালগঞ্জ-কাশিয়ানী) আসনের গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চন্দ্রদীঘলিয়া ইউনিয়নের দুই হাজার ৭৬৫ জন নারী ভোটারের ভোট দেওয়ার অধিকারটুকু ছিল না। পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মাদ্রাসার তৎকালীন মাহতামিমের (প্রধান) ফতোয়ায় যুগ যুগ ধরে এখানকার নারীদের ভোটদান বন্ধ ছিল। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচন ও ২০০৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রশাসন নারীদের ভোটদান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। তবে এবার সংসদ নির্বাচনে নারীরা ভোট দিয়েছেন স্বতঃস্কূর্তভাবে। নারী ভোটও পড়েছে রেকর্ড পরিমাণ।
চন্দ্রদীঘলিয়া গ্রামের অন্ধ মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন ভূঁইয়া (৬২) তো বলেই ফেললেন, জন্মের পর মাইয়াগে-ভোট দিতে দেখি নাই। শুনছি মাদ্রাসার কারণে আমাগো চেয়ারম্যান ভোট দিতে না করে। গ্রামের রক্ষণশীল ঐতিহ্যবাহী মোল্লা পরিবারের দুই গৃহবধূ সেলিনা জামান (২৭) বিএ। আর আজিফা জামান (৩২) এসএসসি পাস। তাঁরা কখনো ভোট দেননি। তাঁরা জানান, এ বাড়ি কেন, গ্রামের কোনো নারী ভোটকেন্দ্রে যান না। স্বামী, দেবর, ভাশুররা যেমন তাঁদের কখনো ভোট দিতে যাওয়ার কথা বলেননি, তারাও কখনো ভোট দেওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করেননি। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের মতো এ গ্রামের কোনো নারীই বোধহয় আগে এ বিষয় নিয়ে ভাবতেন না। এটা নারীদের দোষ না। দোষ সমাজব্যবস্থা ও নেতাদের। এখন আমাগো মতো অন্য নারীরাও ভোট নিয়ে ভাবতেছে। এবার সংসদ নির্বাচনে ভোট দিছি। ঠিক করেছি, উপজেলা নির্বাচনেও ভোট দিতে যাব।’ আজিফা জামানের স্বামী ওহেদুজ্জামান (৪০) ঢাকায় ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, ‘এবার নারীরা ভোট দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এর বিরুদ্ধে নই। স্ত্রী, ছোট ভাইয়ের বউসহ সবাই এবার ভোট দিয়েছেন তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে।’
গ্রাম্য চিকিৎসক ফজলুর রহমান (৪৮), আহম্মদ মোল্লা (৮০), জামাল ভঁূইয়া (৪৫), মহোর আলী মোল্লা (৫৫), মহর আলী ফকির (৮১), আবুল খায়ের মোল্লাসহ (৫০) অসংখ্য মানুষ জানিয়েছে, পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে এক নির্বাচনে এক মহিলার জাল ভোটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় চন্দ্রদীঘলিয়া মাদ্রাসার তৎকালীন মাহতামিম নারীদের ভোট না দেওয়ার পরামর্শ দেন। আর স্থানীয় রাজনীতিকেরা তাঁদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় নির্বাচনের আগে বড় হুজুরের কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে নারীদের ভোট না দেওয়ার বিষয়টিকে ঐতিহ্য হিসেবে প্রচার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।
দীর্ঘদিন ধরে সরকারি-বেসরকারি প্রচারণায় এলাকায় মহিলা-পুরুষ সবার মধ্যে বিষয়টি নাড়া দিয়েছে। নারীদের ভোটদানের ব্যাপারে জনমতও সৃষ্টি হয়েছে। চন্দ্রদীঘলিয়া ঘুরে নারী ও পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে তার প্রমাণও পাওয়া গেল। ভবাহানুছা বেগম (৬০) নামের এক নারী বললেন, জীবনে তিনি ভোট দেননি, এবার দিয়েছেন। শাহিন মোল্লা (৩৫) বলেন, ‘মহিলাগে ভোট দিতে না দেওয়া রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে কিছু মহিলা ভোট দেছে। তয় এবার পরিবেশ সবচেয়ে ভালো ছিল। তাই প্রায় সব মহিলাই ভোট দেছে। উপজেলায়ও ভোট দেবে। চন্দ্রদীঘলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ভোটদানে নারীদের বরং উৎসাহিত করে আসছেন। আমি নিজে চেয়ারম্যান হিসেবে অনেককে বুঝিয়েছি। অনেক সভার আয়োজন করেছি। মাদ্রাসাও কোনো ব্যাপার না। আসলে মানুষের সচেতনতার অভাব ছিল। এবার চিত্র পাল্টে গেছে। স্বেচ্ছায় নারীরা ভোট দিতে কেন্দ্রে আসছে।’
চন্দ্রদীঘলিয়া মাদ্রাসার মাহতামিম মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ইসলামে নারীদের ভোট না দেওয়ার কোনো উল্লেখ নাই। এখন এ যুগে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীরা পর্দাপ্রথা মেনে ভোট দিলে ইসলামে কোনো বাধা নেই।’ মাদ্রাসার তৎকালীন বড় হুজুর নারীদের ভোট না দেওয়ার ব্যাপারে ফতোয়া দিয়েছিলেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব আমার আগের ঘটনা। এ বিষয়ে আমার চেয়ে প্রাচীন মুরব্বিরাই ভালো জানেন।’
সুজনের জেলা সভাপতি কবি রবীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেন, প্রশাসন ও বিভিন্ন এনজিওর কয়েক বছর ধরে প্রচারণার কারণে এবার ব্যাপক হারে নারী ভোট পড়েছে। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা এস এম আশফাক হুসেন বলেন, ‘কাউকে জোর করে নয়; সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মানুষকে নারী ভোটের ব্যাপারে সচেতন করা হয়েছে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কারণে চন্দ্রদীঘলিয়ায় এবার সংসদ নির্বাচনে ৮৫ শতাংশ নারী ভোট পড়েছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও একই ধরনের ভোটার উপস্থিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
সুব্রত সাহা বাপী, গোপালগঞ্জ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৪, ২০০৮
Leave a Reply