এই বাংলাদেশেরই একটি অজপাড়াগাঁয়ের স্কুলছাত্রী লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের মানুষজনকে এক করে নিজের বাল্যবিবাহ নিজেই ঠেকিয়েছে। খবরটি এসেছে প্রথম আলোয়। এসেছে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলেও। আসবে না? এ যে বিরল ঘটনা। এত সচেতনতা, এত প্রচার-তার পরও যে বাল্যবিবাহ হয়েই যাচ্ছে। অভিভাবকেরা মনে করেন, ‘সুপাত্র’ হাতছাড়া করা যাবে না। হোক না মেয়েটির বয়স ১৮ বছরের নিচে, হোক না বরের সঙ্গে কনের বয়সের তফাৎ, তবুও মেয়ের ‘ভালো’র জন্যই···। হায়রে ‘ভালো’! ‘ভালো’তে অস্থির হয়ে ঢাকা শহরের এক স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া একটি মেয়ে প্রথম আলো কার্যালয়ে এসে বলে, ‘আমার ভালোর জন্য আমাকে এখনই বিয়ে দিতে চায় মা-বাবা। ভালো ছেলে পেয়েছে মনে করে। কিন্তু আমি এখন শুধু লেখাপড়া করতে চাই। সবে তো কলেজে ভর্তি হলাম।···’ বাল্যবিবাহের এমন চিত্র এ দেশের জন্য নতুন কিছু নয়, কিন্তু যখন ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে শিশু-কিশোরদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্ব সম্মেলনে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান এম ভেনেমান উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং পরে সংবাদ সম্মেলনে বারবার বাল্যবিবাহ রোধের ওপর জোর দেন, তখন মনে হয়, বাংলাদেশের এই চিত্রটি রোধ করা কতটা জরুরি। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক পরিষ্কার ভাষায়ই বললেন, ‘শিশুদের যৌন হয়রানির নানা কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে, তবে আমি মনে করি বাল্যবিবাহের মাধ্যমে ছোট মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। একটা ছোট মেয়ে যখন তার চেয়ে তিনগুণ বয়স্ক একজন মানুষকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়, তখন এর চেয়ে বড় যৌন হয়রানির আর কি-ই বা আছে? এটা বন্ধ করতে হবে।’
এটা ঠিক, ঘরের বাইরে শিশুরা যৌন হয়রানির যেমন শিকার হয়, পারিবারিক পরিবেশেও তারা এই নির্যাতনের শিকার হয়। অনেকের কাছে হয়তো শিশু নির্যাতনের এই কথাগুলো শুনতে শুনতে ক্লিশে মনে হতে পারে। কিন্তু ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাশিও লুলা দা সিলভা রিও সেন্টারে সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসে তাঁর বক্তৃতায় শিশু ও কিশোরদের যৌন হয়রানি রোধে পারিবারিক বিষয়টিকে অত্যন্ত জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের কর্মকর্তা। গত ২৫ থেকে ২৮ নভেম্বর এই সম্মেলনে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে ওয়াহিদা বানুর নেতৃত্বে অপরাজেয় বাংলাদেশের কিশোরীরা তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিশু-কিশোরী এবং অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে। ভাষা কোনো বাধাই নয়। সবার কানেই ঝুলেছে অনুবাদের হেডফোন।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাংলাদেশের চিত্র এবং বিভিন্ন সময়ে নেওয়া পদক্ষেপের বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনায় তিনি বলেছেন, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পাচারবিরোধী মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন (এনপিএ) অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় দিকের সহযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে নারী ও শিশু পাচার রোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের চিত্র বর্ণনায় উল্লেখ ছিল ওয়ান স্টপ ক্রাইসিসের কথা। আটটি মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস। সম্মেলন চলাকালে কথা হয় জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলীর সঙ্গে। তিনি বিশেষভাবে বলেছিলেন, আইনের বাস্তবায়নটাই জরুরি। সম্মেলন থেকে ফিরে গিয়ে প্রতিশ্রুতি মানাটাই আসল কথা।
বিশ্বকাপ ফুটবলে পছন্দের দল হিসেবে ব্রাজিলের জাতীয় সংগীতটা অনেকেরই চেনা। রিও সেন্টারের মিলনায়তনে প্রায় তিন হাজার অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতিতে ব্রাজিলের জাতীয় সংগীতটির সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ব্রাজিলের শিশু-কিশোররা গলা ছেড়ে গাইছিল তাদের জাতীয় সংগীত। তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের কিশোরীর দল সতীর্থদের জাতীয় সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল। কিন্তু অন্তরে নিশ্চয়ই তাদের বাজছিল-আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি··· এই বাংলায় আমরা যেন আর নির্যাতনের শিকার না হই।
সুমনা শারমীন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৪, ২০০৮
Leave a Reply