জীবনধারায় পরিবর্তন আসে প্রতিবছরই। জীবনযাপন, ফ্যাশন, স্টাইল, খাবার-দাবার-এসব ক্ষেত্রে এখন প্রতিবছরই নতুন নতুন ধারা কমবেশি চোখে পড়ে। ২০০৮ সালে আমাদের জীবনধারায় বেশি প্রভাব ফেলেছে যেসব বিষয়, সেগুলো তুলে ধরা হচ্ছে এ প্রতিবেদনে।
প্রিয় সঙ্গী ফেসবুক
নাতাশা হায়াতের প্রিয় সঙ্গী এখন ফেসবুক। ‘কত কত হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে এই ফেসবুকে। তাদের সঙ্গে যে আবার কখনো দেখা হবে চিন্তাও করতে পারিনি। কিন্তু এখন দিব্যি যোগাযোগ রাখতে পারছি সব সময়। আর ইন্টারনেট ব্যবহারটাও এখন এসে গেছে একদম হাতের মুঠোয়। মুঠোফোনে নেট-সুবিধা থাকায় যখন-তখন দেখে নিতে পারছি বিভিন্ন জনের তাৎক্ষণিক অবস্থা। একটু পরপর দেখে নিচ্ছি নতুন কোনো বার্তা আছে কি না। সেই সঙ্গে শাহেদকেও নিয়ে এসেছি এই দলে।’ বললেন নাতাশা। অভিনেতা শাহেদকে নাকি এখন একটু পরপরই দেখা যাচ্ছে মুঠোফোনে নেট ব্যবহার করতে। সত্যিই প্রযুক্তি যখন হাতের মুঠোয় তখন একে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বাধা কোথায়।
ফেসবুক আর মুঠোফোনের ইন্টারনেটে কি শুধুই বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ? না। রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তাও চলছে সমান তালে। আর তাই তো দেখা গেছে, গত বছরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ মাধ্যমগুলোতেই তরুণ ভোটাররা প্রচারণা চালিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ভোট না দেওয়ার দলগত আহ্বান জানানো হয়েছে। আবার ‘না’ ভোটের পক্ষে-বিপক্ষেও চলেছে প্রচারণা। ফেসবুকের পাশাপাশি ২০০৮ সালে জনপ্রিয়তা বেড়েছে এফএম রেডিওর। কানে কানে এফএম রেডিও এখন তো চলতি পথের অতি পরিচিত দৃশ্য।
প্রথমবার মত প্রকাশ
গত বছরের শেষদিকে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল নতুন ভোটার। নতুন ভোটারদের মধ্যে অধিকাংশই ১৮ বছর পূর্ণ করে এবারই প্রথম ভোটার হতে পেরেছেন। নির্বাচনে ভোটাধিকারের মাধ্যমে তাঁরা পেয়েছেন স্বাধীন মত প্রকাশের স্বীকৃতি।
তরুণীদের ফ্যাশনে স্বদেশিয়ানা
গত বছর তরুণীদের ফ্যাশনটা ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়ানো। কিন্তু একটা দিক স্থির ছিল, আর তা হলো স্বদেশি আধুনিকতা। অর্থাৎ আধুনিকতা থাকবে, তবে তা কাউকে অনুসরণ করে নয়। ‘গত কয়েক বছরের ফ্যাশনধারায় দেশীয় পণ্য ব্যবহার করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে সেটা এখনই একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে তা বলছি না। কিন্তু গন্তব্যে যাওয়ার লক্ষ্যেই অব্যাহত রয়েছে এই ধারা’-এভাবেই বিশ্লেষণ করলেন বিপ্লব সাহা। তিনি মনে করেন, দেশীয় পণ্যের মাধ্যমে ফ্যাশনটাকে চর্চা করার মানসিকতা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনিভাবে বেড়েছে নিজস্ব উৎসবগুলোকে নিজস্ব চেতনার মাধ্যমে উদযাপন করার রীতি। আর তাই তো বিদেশের বাজার ঘুরে বর-কনের জন্য দেশি পোশাক কেনার চেয়ে ফরমায়েশি নকশায় দেশীয় বিয়ের পোশাকটাই হয়ে উঠেছে ফ্যাশনেবল। মাহিন খান মনে করেন, ঐতিহ্যগতভাবে সমৃদ্ধ জামদানি, মসলিন, সিল্কের কদর যেমন বাড়ছে তেমনিভাবে নিজস্ব ডিজাইনে বরের পোশাকও হয়ে উঠছে আভিজাত্যে পরিপূর্ণ।
সালোয়ারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
মেয়েদের কামিজ কখনো হাটু ছুঁয়ে গেছে বা কখনো ছোঁয়নি কিন্তু সালোয়ারের ডিজাইন ছোট-বড় বা শ্রেণীভেদে কিন্তু ধুতি ডিজাইন বা চাপা সালোয়ারেই সীমাবদ্ধ ছিল বছরজুড়ে। আর এ ধরনের সালোয়ারের সঙ্গে ভালো লাগবে না যেকোনো জুতো বা স্যান্ডেল। তাই মেয়েরা বেছে নিয়েছিল একদম ফ্ল্যাট স্যান্ডেল। সরু ফিতার এসব ফ্ল্যাট স্যান্ডেলই মেয়েদের পায়ে পায়ে বছর ঘুরিয়েছে। একদম ফ্ল্যাট স্যান্ডেলে এই চাহিদার কথা জানিয়েছেন রাখী সুজ-এর বিপণন কর্মকর্তা নাদিম।
বিবিয়ানার ডিজাইনার লিপি খন্দকার মনে করেন, গত বছর ধুতি-সালোয়ারের পাশাপাশি জিন্স বা ফরমাল প্যান্ট সঙ্গে শার্ট, টপস, কোর্তাও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সেসব টপ আবার একদমই ফতুয়া স্টাইলে নয়। বরং বডি ফিটিং কাটই পেয়েছে প্রাধান্য। আর কোর্তায় জনপ্রিয় হয়েছে এ লাইন কাট। সুতির পাশাপাশি টপসের ক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছে জর্জেট, সিল্ক, এন্ডি কাপড়।
গয়নায় দেশি উপাদান
মাহিন খান জানিয়েছেন, গত বছরে মেয়েদের গয়নায় ব্যবহার হয়েছে দেশীয় উপাদান। যেমন সুতা, পুঁতি, কড়ি, কচুরিপানা ইত্যাদি। আর এসব উপাদানে তৈরি গয়নায়ও ছিল দেশীয় আমেজ। সেই সঙ্গে যেকোনো ডিজাইন হলেই হলো তেমনটা নয়। বরং এক লহর দুই লহরে লম্বা মালার ফ্যাশনটা ছিল বছরজুড়েই জোরালো। শাড়ি কিংবা টপস-কোথায় ছিল না এই মালা? ফ্যাশনসচেতন সব তরুণীর সঙ্গী হয়েছে লম্বা মালা। কখনো পুঁতির আবার কখনো পাথরের। মেয়েদের পোশাকে একটা বিশেষ জিনিস দিয়ে বাড়তি যোগের কথা জানালেন মাহিন খান। তা হলো লেইস। বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন রকমের লেইসের ব্যবহার হয়েছে মেয়েদের পোশাকে। সুতি, এন্টিক, কাতান, নাইলন, কুরুশ বিভিন্ন ধরনের লেইস চলেছে সমান তালে।
কত কায়দা চুলে
পোশাক ও গয়নাগাটিতে যখন ছিল ভিন্নতা, তখন চুলটাই বা বাদ যায় কেন? বছর ঘুরে ভীষণ চলেছে ব্যাঙস কাট। সামনে না ছাঁটা চুল যেন দুম করেই হাওয়া হয়ে গেল গত বছরে। পেছনে স্টেপ, লেয়ার যা-ই থাকুক না কেন সামনের চুল ছাঁটতেই হবে ব্যাঙস কাটে, এমনটাই ছিল তরুণীদের চাহিদা। জানালেন রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান। সেই সঙ্গে চুল ছেঁটেছে ভলিউম লেয়ার, আনইভেন স্টেপস ও বব ছাঁটে। আবার চুলের বাড়তি সংযোজন হিসেবে ব্যবহার করেছে গ্লিাটার, রিবন, স্টোন। সেই সঙ্গে চুল রং না করেও লাগিয়েছে রং করা চুল।
চাই ব্র্যান্ড
ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকতে দেখা গেছে বেশির ভাগ তরুণ-তরুণীকে। তা সে পোশাকই হোক বা জুতো কিংবা পারফিউম অথবা লিপস্টিক। এমনকি ঘর সাজানোর জিনিসটিও যেন হওয়া চাই ব্র্যান্ডের। আবার কাউকে উপহার দিতে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন ব্র্যান্ডের জিনিস। আর এই ব্র্যান্ডদৌড়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি কিন্তু সমান তালে এগিয়ে ছিল দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো। খাবারটাও যেন হওয়া চাই ব্র্যান্ডের। তাই পিৎজা হাট, কেএফসির মতো চেইনশপগুলোর দোরগোড়ায় বছরজুড়েই ছিল ব্র্যান্ডপ্রিয় মানুষের ভিড়। শুধু কি তাই? বাড়ির পাশের নাপিত দিয়েই যে চুল কাটা সেরেছেন বাপ-দাদারা আজীবন, তাঁরাই দেখা গেছে চুল কাটছে টোটাল কেয়ার কিংবা হাবিবস @ পারসোনায়। এমনই রমরমা ছিল ব্র্যান্ডপ্রিয়তা।
রান্না তো শিল্পই
বাঙালি যেন বছরজুড়ে স্বাদ নিয়েছে বাংলা খাবারের। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড থেকে শুরু করে প্রাণ-প্রথম আলো আচার প্রতিযোগিতা, রাঁধুনীর দেশব্যাপী রান্না প্রতিযোগিতা, এমনকি ওয়েবে এসিআই রেসিপি প্রতিযোগিতা যেন সেদিকেই নির্দেশনা দেয়। আর সেই সঙ্গে সারা বছর রান্নার বই তো জনপ্রিয় ছিলই। ২০০৮ সালে প্রথম আলোর নকশায় প্রকাশিত রেসিপিগুলোর সংকলন নকশার রান্না প্রকাশিত হয়। আরও বেরিয়েছে টমি মিয়া, সিতারা ফিরদৌস, রাহিমা সুলতানা রীতাসহ অনেকের রেসিপির বই।
রান্নাই নয় কেবল সেই খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা এমনকি পরিবেশনের সৌন্দর্য সম্পর্কেও ছিল সবার মনে ব্যাপক আগ্রহ। বাড়িতে অতিথি এলে মোগলাই খাবারের পরিবর্তে ভাত, ডাল, ভর্তার কয়েক পদের রেসিপি যেন খাবারেও নিয়ে এসেছে স্বদেশিয়ানা।
অন্দরসজ্জায় দেশি উপাদান
ঘর সাজানোর প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে দেশি পণ্যের ব্যবহার। বাঁশের ল্যাম্পশেড কিংবা গাজীর পটচিত্রের দেয়ালচিত্র শোভা বাড়িয়েছে বসার ঘরের। অতিথি আপ্যায়নে টেরাকোটার ডিনারসেট যেন দেশীয় সত্তাকে মূর্ত করেছে বছরজুড়েই। পারশিয়ান কার্পেটের বদলে রংপুরের শতরঞ্জি কিংবা ক্রিস্টালের শোপিসের পরিবর্তে টেরাকোটার শোপিস যেন ঘর সাজিয়েছে নতুন আঙ্গিকে। পর্দার বদলে চিকের ব্যবহারও নান্দনিকতার পরিচয় দেয়। সেই সঙ্গে দেশকে ভালোবেসে দেশীয় পণ্যে ঘর বদলানোর অনুপ্রেরণা দেয়!
বেড়ানো যেন বাঙালি জীবনের এক নতুন আয়োজন হয়ে উঠেছে।
দে ছুট···
২০০৮ সালে ছুটিছাঁটায় ঘরে বসে থাকতে দেখা যায়নি অনেককে। আর এর স্পষ্ট প্রভাব পড়তে দেখা গেছে ছুটিছাঁটার সময় বাস, ট্রেন বা বিমানের টিকিট কাউন্টারে। টিকিট নেই টিকিট নেই। এমন হাহাকার উঠেছে বছরের বিভিন্ন সময়ই। আর হোটেল বুকিং না দিয়ে গেলে যে ছুটিছাঁটায় বেড়াতে গিয়ে ধরা খাওয়ার আশঙ্কার বিষয়টি তো রয়েছেই। তাই বেড়ানো এখন যেমন বাঙালির রক্তে ঢুকে গেছে তেমনি তারা এই বেড়ানোর উদ্যোগটাও বেশ পেশাদারিভাবেই নিচ্ছে। বেশ পরিকল্পনা করে তবেই রওনা হচ্ছে গন্তব্যে।
ফারহানা আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৬, ২০০৮
Leave a Reply