নওরিন ও নওশিন দুই বোন। একই স্কুলে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে দুটি ভিন্ন স্কুলে ভর্তি হতে হয়েছে তাদের। স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। একজনের স্কুলে থাকতে ভালো লাগলেও অন্যজনের তা লাগে না। বাসাই ওর কাছে ভালো। এ রকম সমস্যা অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। হঠাৎ চেনাজানা পরিবেশ থেকে নতুন পরিবেশে তারা সহজে মানিয়ে নিতে পারে না। সে ক্ষেত্রে অভিভাবক ও স্কুলের সবার আন্তরিক সহযোগিতাই পারে শিশুটিকে সাহায্য করতে। এমনটিই মনে করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক শামীম জাহান আহসান। তিনি বলেন, ‘সব শিশুরই একইভাবে মানসিক পরিপক্বতা গড়ে ওঠে না। ফলে নতুন পরিবেশে অনেকেই নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না। অচেনা পরিবেশে তারা কিছুটা ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। নিজেকে অসহায় ভাবতে শুরু করে। তা ছাড়া তারা শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে স্কুলের এই পরিবেশে সহজ হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে শিশুটির উপযোগী পরিবেশ বাড়িতে ও বিদ্যালয়ে তৈরি করতে হবে। তার সব কাজে উৎসাহ দিতে হবে। তাকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। অভিভাবকদেরও সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তবে অতি সচেতনতায় যেন হিতে বিপরীত না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। আর স্কুলগুলোতে সে রকম ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে প্রথম কয়েকটি দিন শিশুরা মা-বাবার যেন একটু সান্নিধ্যে থাকে। তাদের একটু একটু করে বুঝিয়ে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে ফেলতে হবে। অবশ্যই অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহনশীল ও ধৈর্যশীল হতে হবে।’
এর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন জিগাতলায় বসবাসরত মুনিরা সুলতানা। তাঁর সন্তানকে এই প্রথম স্কুলে ভর্তি করেছেন। আদরের সন্তানকে নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তিনি স্কুল সম্পর্কে সব সময় সন্তানের কাছে ইতিবাচক ধারণা দিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মানে অভিভাবকদের কখনোই উচিত নয় শিশুদের স্কুল ও শিক্ষক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেওয়া। সে যেন কোনোভাবেই ভয় না পায়, মন খারাপ না করে সে জন্য তার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। তার পছন্দ-অপছন্দের প্রতি লক্ষ রেখে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।’
‘বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশের শিশুরাও অনেক চৌকস হয়ে উঠছে। তিন বা সাড়ে তিন বছরেই তারা যেন নিজেদের স্কুলে যাওয়ার উপযোগী করে তৈরি করে ফেলে।’ এ কথা বলেন সানিডেল স্কুলের অধ্যক্ষ তাজিন আহমেদ।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রি-স্কুল ক্লাসের পরিবেশ আনন্দময় করে তুলতে হবে। খেলার মাধ্যমে তাকে সব শেখাতে হবে। শিশুকে সময় দিয়ে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। পড়াশোনাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের কৌশল শিক্ষকদের রপ্ত করতে হবে। শিশুকে শাসন না করে বুঝিয়ে বলতে হবে।’
চার বছর বয়সী প্রান্ত ওর মার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে, ‘স্কুলের জন্য আগের মতো ঠিকভাবে খেলতে পারি না। আম্মু সারাক্ষণ পড়তে বলে।’ ওর কথার রেশ ধরেই প্রান্তর মা বলেন, ‘আসলে স্কুলগুলোতে প্রতিযোগিতা বেশি। রেজাল্ট ভালো করার ইচ্ছা তো সবারই থাকে। সে জন্য বাড়তি চাপ না দিয়ে নিয়মিত অল্প অল্প করে পড়াশোনা করানো উচিত। আমার ছেলে খেলতে পছন্দ করলেও কারও সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না। স্কুলে প্রথম প্রথম বেশ সমস্যা হয়েছে। কারও সঙ্গে নিজের কোনো কিছু শেয়ার করতেও পারত না। বাসায় আমরা নানাভাবে ওকে বুঝিয়েছি। সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন ওর ক্লাসের শিক্ষকেরা। তাঁরা বিভিন্ন খেলা, গল্পের মাধ্যমে তাকে সবকিছু শেয়ার করতে শিখিয়েছেন। এখন ওর অনেক বন্ধুও হয়েছে।’
আপনার সর্বাত্মক চেষ্টা ও সহযোগিতাই পারে শিশুটিকে আনন্দ দিতে। সে যেন কোনোভাবেই শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত বোধ না করে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। তবেই স্কুলের পথে আপনার ছোট্ট সোনামণির ছোট ছোট পায়ের প্রথম পদক্ষেপ স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে।
তৌহিদা শিরোপা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৬, ২০০৮
Leave a Reply