৯০টি ওয়ার্ডের শহর ঢাকা। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে সমস্যা অনেক, কিন্তু সমাধান নেই। অভিযোগ অনেক, অথচ শোনার কেউ নেই। আমরা শুনতে চাই আপনার সমস্যার কথা। সেই সঙ্গে জানতে চাই আপনার সাফল্য-সম্ভাবনা আর ঐতিহ্যের খবরও। আর সে জন্যই ‘ঢাকায় থাকি’র ওয়ার্ডভিত্তিক এই নিয়মিত আয়োজন। আজ ছাপা হলো ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের কথা।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আর নতুন ঢাকার আধুনিকতার উপস্থিতি চোখে পড়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে। এ ওয়ার্ডের বেশির ভাগ এলাকার অবকাঠামোতে দেখা যায়নি পরিকল্পনার ছাপ। অবশ্য এখানকার একমাত্র পরিকল্পিত এলাকা হচ্ছে হাটখোলার ভগবতী ব্যানার্জি রোড। এ ওয়ার্ডের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী নানা উপাদান। এখানে রয়েছে দেশের বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির বাজার ও স্টুডিওপাড়া। এসব উপাদান ওয়ার্ডবাসীর জন্য গর্বের বিষয়। তবে নানা নাগরিক সমস্যার কারণে বিড়ম্বনার মধ্যে আছে তারা। ওয়ার্ডবাসীর এ বিড়ম্বনা ও ওয়ার্ডে থাকা তাদের গর্বের বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন আপেল মাহমুদ ও ওবায়দুর রহমান মাসুম।
ওয়ার্ড পরিচিতি
” অভয় দাস লেন
” রামকৃষ্ণ মিশন রোড (১ থেকে ৯১/১ নম্বর হোল্ডিং পর্যন্ত)
” কেএম দাস লেন
” জয়কালী মন্দির রোড
” টয়েনবি সার্কুলার রোড
” ফোল্ডার স্ট্রিট
” ভগবতী ব্যানার্জি রোড
” হাটখোলা (২ নম্বর থেকে ৪৪/৩ নম্বর হোল্ডিং পর্যন্ত)
একনজরে
আয়তনঃ প্রায় তিন বর্গকিলোমিটার।
জনসংখ্যাঃ ৬৫ হাজার।
ভোটার সংখ্যাঃ ২৬ হাজার।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানঃ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি, উচ্চবিদ্যালয় পাঁচটি ও কলেজ তিনটি।
উপাসনালয়ঃ মসজিদ ১২টি, মন্দির পাঁচটি।
কবরস্থানঃ তিনটি (দক্ষিণ মুহসেন্দি কবরস্থান, উত্তর মুহসেন্দি কবরস্থান ও গোপীবাগ কবরস্থান)।
মাঠঃ একটি (শহীদ জিয়া মাঠ)।
পুকুরঃ একটি (কে এম দাস লেনের এনটিআরএস পুকুর)।
বাজারঃ একটি (গোপীবাগ বাজার)।
যেভাবে এল নামগুলো
হুঁকার কলকিতে আগুন ধরানোর জন্য ব্যবহৃত টিকিয়া থেকে টিকাটুলীর নামকরণ হয়েছে। কয়লার গুঁড়ো দিয়ে টিকিয়া তৈরির জন্য সেখানে বেশকিছু লোক বংশপরম্পরায় বসবাস করত। তাদের তৈরি টিকিয়ার খ্যাতিও ছিল দেশব্যাপী। জনশ্রুতি রয়েছে, টিকাটুলীর টিকিয়া এতই নিখুঁত ও হাল্কা ছিল যে একটি দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কয়েকটি টিকিয়ায় আগুন ধরানো যেত।
টিকাটুলীর একটি অংশে স্থানীয় লোকজনের বেচাকেনার জন্য একটি হাট বা বাজার বসত। ফলে সে জায়গাটির নাম হয়েছে হাটখোলা। এ হাটখোলা থেকেই গড়ে উঠেছে হাটখোলা রোড ও হাটখোলা লেন।
ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের নামে হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন রোড। একইভাবে জয়কালী মন্দির রোডের নামকরণ হয়েছে জয়কালী মন্দির থেকে। ওয়ারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফোল্ডার স্ট্রিট এলাকাটি পড়েছে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে। ইংরেজ সিভিলিয়ান মি• ফোল্ডারের নামানুসারে ফোল্ডার স্ট্রিট রাখা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বনাথ চৌধুরী জানান, কে এম দাস রোডের নামকরণটি হয়েছিল স্থানীয় জমিদার কামিনী মোহন দাসের নামানুসারে। অপরদিকে বিচারপতি অভয় দাসের নামে নামকরণ করা হয়েছিল অভয় দাস লেনের নাম।
স্থানীয় বাসিন্দা সুমন চন্দ্র দাস জানান, হাটখোলার পশ্চিম পাশে রয়েছে ভগবতী ব্যানার্জি রোড। তিনি ছিলেন এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি। বলধার জমিদারের প্রিয়বন্ধু ছিলেন ভগবতী ব্যানার্জি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ময়লার ভাগাড়
সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ ও কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় ময়লার কনটেইনার রাখায় তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির পরিবেশ নষ্ট করছে। গিয়ে দেখা গেছে, কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে পূর্বদিকে অভয় দাস লেনে রাস্তার অনেক অংশজুড়ে একটি ময়লার ডাস্টবিন রাখা হয়েছে। এখানে এলাকার বিভিন্ন বাসা থেকে ময়লা এনে ফেলা হচ্ছে। ডাস্টবিন ছাড়িয়ে ময়লা রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ছে। সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের সামনের রাস্তাতেও একটি ময়লার কনটেইনার রাখা হয়েছে। সেখানেও আশপাশের বাড়ি থেকে ময়লা এনে ফেলা হচ্ছে। ময়লা ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। ছাত্রী ও পথচারীদের নাকে রুমাল চেপে চলতে হয়। কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর অভিভাবক রহমত উল্লাহ বলেন, এত জায়গা থাকতে এখানে ডাস্টবিন রাখার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ডাস্টবিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির পরিবেশই নষ্ট করে দিয়েছে।
অপরূপ রোজগার্ডেন
টিকাটুলীর ১৩ কে এম দাস লেনের ‘রোজগার্ডেন’ নামের সাদা রঙের বাড়িটি নজর কাড়ে সবার। একসময় এখানে বিরল ও দুর্লভ প্রজাতির গোলাপের বিশাল বাগান গড়ে তোলা হয়েছিল। এ কারণে এই বাড়ির নাম রোজগার্ডেন রাখা হয়েছিল বলে জানান বাড়ির বর্তমান মালিক কাজী আহমেদ রাশেদ। ১৯৬২ সালের বন্যায় বাগানের সব গোলাপগাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে আর সেভাবে বাগানটি গড়ে তোলা যায়নি।
রোজগার্ডেন গড়ে ওঠার ইতিহাস সম্পর্কে কাজী আহমেদ রাশেদ জানান, ঢাকার বিশিষ্ট স্বর্ণের ব্যবসায়ী হৃষিকেশ দাস একবার বলধা গার্ডেনের এক গানের জলসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু নি্নবর্ণের হিন্দু হওয়ায় তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। যে কারণে অপমানিত হয়ে তিনি জলসা থেকে ফিরে গিয়েছিলেন নিজ বাড়িতে। এ অপমানের শোধ নেওয়া এবং উচ্চশ্রেণীর অন্তভুêক্ত হওয়ার জন্য তিনি ১৯৩০ সালের দিকে গোপীবাগ এলাকায় ২২ বিঘা জমি কিনে সেখানে রোজগার্ডেন নামের বাগানবাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করতে গিয়ে হৃষিকেশ দাস ব্যবসায় মনোযোগ দিতে পারেননি। ঋণে জর্জরিত হয়ে তিনি বাড়িটি ১৯৩৬ সালে তাঁর বন্ধু কাজী আব্দুর রশীদের কাছে বিক্রি করে দেন।
১৯৬৯ সালে রোজগার্ডেন বেঙ্গল মোশন পিকচার্সের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। তখন সেখানে সিনেমার চিত্রায়ণ ছাড়াও ডাবিং ও সম্পাদনার কাজ করা হতো। একপর্যায়ে এর মালিকানা নিয়ে ভাড়াটিয়া ও মালিকের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমা হয়। বেঙ্গল স্টুডিও ১৯৯৩ সালে এখান থেকে চলে যায়। কাজী আহমেদ রাশেদ বলেন, ‘এটি শুধু আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য নয়, এটা ঢাকার ঐতিহ্যেরও একটি অংশ। এটা আমরা অবশ্যই ধরে রাখব। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটাকে ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করলেও এর সংস্কারে এগিয়ে আসেনি। আমাদের নিজেদের টাকা খরচ করে এটি সংস্কার করেছি।’
দীপালি স্কুল থেকে কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়
শ্রীমতী লীলা রায়ের প্রতিষ্ঠিত দীপালি স্কুলের পরিবর্তিত রূপ হলো আজকের কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। ২৫ নম্বর অভয় দাস রোডে এই বিদ্যাপীঠের জন্ম হয়েছিল ১৯২৪ সালে। জানা যায়, নারী শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ও খ্যাতনামা নারীনেত্রী শ্রীমতী লীলা রায় টিকাটুলীতে দীপালি স্কুল খুলেছিলেন। পরে তা কামরুন্নেসা বিদ্যালয়ে পরিণত হয় ঢাকার নওয়াব বাড়ির প্রচেষ্টায়।
কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ওবায়দা বানু জানান, তাদের নথিতে দীপালি স্কুল কিংবা লীলা রায়ের কোনো নাম নেই। ১৯৪৭ সালে কামরুন্নেসা স্কুল সরকারীকরণ হয়। ২ দশমিক ৪ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে বিদ্যালয়টি। বিগত জোট সরকারের সময় বিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি কলেজ সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য বিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত একটি প্রাচীন পুকুর ভরাট করা হয়। কিন্তু বর্তমানে কলেজ শাখা খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে প্রধান শিক্ষিকা জানান।
একাত্তরের সম্মুখযোদ্ধাদের আবাসস্থল
মহান মুক্তিযুুদ্ধে এ ওয়ার্ডের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আর কে মিশন রোডের ওয়াকিলুর রহমান মুরাদ ছিলেন গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার। তিনি নারায়ণগঞ্জের বালিয়াপাড়া এলাকায় ক্যাম্প করেছিলেন। সেখান থেকে ঢাকায় গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করতেন। তিনি ১৯৮২ সালের দিকে মতিঝিলে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বর্তমানে তাঁর নামে আর কে মিশন রোডের একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জুয়েলের বাসা ছিল কে এম দাস লেনে। তিনি সাভারে পূর্ব পাকিস্তান রেডিও স্টেশনে অভিযান চালানোর সময় হানাদার বাহিনীর গুলিতে মারা যান। আর কে মিশন রোডের মুক্তিযোদ্ধা জাকির ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করতেন। কুমিল্লার মন্দবাগ পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তিনি শহীদ হন। আর কে মিশন রোডের আরেক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট সামাদ। যুদ্ধের সময় তিনি সিলেটের সালুটিকর বিমানবন্দরে মারা যান। গোপীবাগ এলাকার শাহজাহান, মুল্লুক জাহান ও বদিউজ্জামান-তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তাঁদের ধরে নিয়ে মেরে ফেলে। সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শামসুল হুদার নাম শোনা যায়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। কাজী আরেফ আহমেদের স্ত্রী রওশন জাহান সাথী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আরও যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, ডিসিসির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মোজাম্মেল হক এবং আর কে মিশন রোডের লে• কর্নেল (অব•) আসাদ আহমেদ খান।
ঐতিহ্যবাহী জয়কালী মন্দির
নগরের প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে জয়কালী মন্দির অন্যতম। মন্দিরের গায়ে এর প্রতিষ্ঠাকাল লেখা আছে ১০০১ বঙ্গাব্দ। এ হিসাবে মন্দিরের বয়স ৪০০ বছরের ঊর্ধ্বে। একসময় মন্দিরের নামে ঢাকার কয়েকটি বাজার বন্দোবস্ত থাকলেও বর্তমানে মাত্র ১০ কাঠা জমি অক্ষত আছে। তাও আবার মন্দিরের চারপাশে ২০টির মতো দোকানপাট তুলে ধর্মীয় পরিবেশ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এ কথা স্বীকার করে মন্দির পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি নরেশ সরকার বলেন, আগের সেবাইত মাধুরী চ্যাটার্জি এসব দোকান বরাদ্দ দিয়েছেন। হিন্দু ছাড়া অন্য কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের লোকদের দোকান ভাড়া দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও তা করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, নবাবি আমলে ঢাকার নবাবদের দেওয়ান তুলসী নারায়ণ ঘোষ, নরনারায়ণ ঘোষ, বাঞ্ছারাম ব্রহ্মচারী প্রমুখের প্রচেষ্টায় জয়কালী মন্দির, প্রস্তরময় কালী, একবিংশতিসংখ্যক শিব, লক্ষ্মীনারায়ণ বিগ্রহ, ত্রিসংখ্যক শালগ্রামচক্র ও বনদুর্গা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর ব্যয় নির্বাহের জন্য সম্পত্তি দেবোত্তর করে দেওয়া হয়েছিল, যা থেকে সে সময় ১২০০ টাকা আয় হতো। সে জন্য নবাবপুর, জয়কালী বাজার ও বুড়িগঙ্গার দক্ষিণপারের কালীগঞ্জ হাটের উপস্বত্ব দেওয়া হয়েছিল জয়কালী মন্দিরের নামে।
নগরের লাঠি-বাঁশি সমিতি
সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের প্রতিহত করার জন্য এই ওয়ার্ডে গড়ে তোলা হয়েছে লাঠি-বাঁশি সমিতি। ২০০০ সালে এই সমিতি গড়ে উঠেছে। এলাকাবাসী জানায়, ২০০০ সালের দিকে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারত না, মেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারত না। গোপীবাগ এলাকা ছিল সন্ত্রাসীদের আখড়া। সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে গোপীবাগ এলাকায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্য ভাড়াটিয়া পাওয়া যেত না। সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এ জন্য লাঠি-বাঁশি সমিতি গড়ে তোলা হয়। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ডিসিসির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের জ্বালায় এলাকায় থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছিল। পরে দলমত-নির্বিশেষে এলাকার সবাইকে নিয়ে মসজিদে মসজিদে বৈঠক করলাম। সবাই মিলে শপথ নিলাম, যেভাবেই হোক সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে হবে। এ জন্য সবার ঘরে ঘরে একটা করে লাঠি ও বাঁশি সরবরাহ করা হয়েছিল। কোনো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দেখলেই বাঁশিতে ফুঁ দিলে এলাকার লোকজন লাঠি নিয়ে হাজির হতো।’
লাঠি-বাঁশি সমিতি গড়ে তোলার পর এলাকার চেহারাই পাল্টে গেছে। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি অনেকটাই কমে গেছে। প্রশাসনের লোকজনও লাঠি-বাঁশি সমিতির কাজকর্মকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে এ সমিতির কার্যক্রম বর্তমানে কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এলাকার শান্তিশৃঙ্খলার জন্যই এর কার্যক্রম আবার জোরদার করা উচিত বলে মনে করেন সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হোসেন মঞ্জু।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিবৃত্ত
মানবসেবার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালের ১ মে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এর এক বছর পর ১৮৯৯ সালে স্বামীজি তাঁর দুজন শিষ্য স্বামী বিরজানন্দ ও স্বামী জ্ঞান প্রকাশানন্দকে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে পাঠান প্রচারক হিসেবে। তাঁরা ঢাকা পৌঁছে কায়েতটুলীর কাশিমপুরের জমিদার সারদা রায় চৌধুরীর বাড়িতে উঠে প্রচারকাজ শুরু করেন। এ সময়কেই ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার সময় ধরা হয় বলে স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দের রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা-এর অতীত ও বর্তমান প্রবন্ধ থেকে জানা যায়।
১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ ঢাকা সফরে এলে মঠ ও মিশনের কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। এ কার্যক্রম চলেছে ভাড়াবাড়িতে। ১৮৯৯ সালে মঠ ও আশ্রমের সূচনাপর্বের কিছুদিন পর ১৯১১ সালে স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য স্বামী পরমানন্দ ঢাকায় একটি গ্রন্থাগার উদ্বোধন করেন। তা ছাড়া প্রথম দিকে আশ্রমের পক্ষ থেকে রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসাসেবা চললেও পরে ঢাকার নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহর সাহায্যে একটি হাসপাতাল খোলা হয়। এভাবে ১৯১৪ সালে ঢাকা মঠ ও আশ্রম বেলুড় মঠ থেকে অনুমোদন লাভ করে। ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী প্রেমানন্দ ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নিজস্ব ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ফরাশগঞ্জের খ্যাতনামা জমিদার যোগেশ চন্দ্র দাসের দান করা সাত বিঘা জমির ওপর মঠ ও মিশন গড়ে ওঠে।
১৯২০ সালে স্বামী বিবেকানন্দের কাছে সন্ন্যাসপ্রাপ্ত স্বামী আত্মানন্দ ঢাকা মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ হয়ে আসেন। এরপর অধ্যক্ষ হয়ে আসেন স্বামী হরিহরানন্দ, স্বামী জগানন্দ, স্বামী প্রেমেশানন্দ, স্বামী অক্ষয়ানন্দ, স্বামী সম্বুদ্ধানন্দ, স্বামী সাধনানন্দ, স্বামী রাঘবেশ্বরানন্দ, স্বামী ত্যাগাত্মানন্দ প্রমুখ। ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন বর্তমানে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় ও মানবিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ওই মঠ ও মিশনের প্রচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, সেবা বিভাগ ও প্রকাশনা বিভাগ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
কী আছে
রামকৃষ্ণ মিশন ” দৈনিক ইত্তেফাক-এর কার্যালয় ” দৈনিক ইনকিলাব-এর কার্যালয় ” বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ” উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় (পূর্ব) ” রামকৃষ্ণ মিশন দাতব্য চিকিৎসালয় ” এনটিআরএস দাতব্য চিকিৎসালয় ” র্যাব-৩ এর কার্যালয় ” হজরত আহমদ শাহ মাজার ” রাজধানী সুপার মার্কেট
” অভিসার সিনেমা হল
কী চাই
” কলেজ ” উদ্যান ” শিশুপার্ক
সমস্যার খতিয়ান
” ৪২/২ কে এম দাস লেনের কসমস অ্যাপার্টমেন্টের সামনে রাস্তা ভাঙা।
” ২৭ কে এম দাস লেনের সামনের রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে।
” পানিনিষ্কাশনের নালা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই কে এম দাস লেন ও আশপাশের এলাকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়।
হাটখোলার স্টুডিওপাড়া
ইত্তেফাক মোড় থেকে রাজধানী মার্কেটে যাওয়ার সময় দেখা যায় বেশ কিছু স্টুডিও। একসময় হাটখোলাব্যাপী শতাধিক স্টুডিও থাকলেও বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে ব্যবসায়িক মন্দার কারণে। অনেকে ফটোগ্রাফি প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে ছবি তোলার পেশা ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানান সোনারগাঁও স্টুডিওর ব্যবস্থাপক ও ফটোগ্রাফার ওমর ফারুক টাবলু।
হাটখোলা স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী সৈয়দ নাসিমুল হোসেন হুমায়ুন জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই হাটখোলার স্টুডিওপাড়া দেখে আসছেন। মূলত তখন ব্যবসাটা লাভজনক হওয়ায় একটার পর একটা স্টুডিও হয়েছে। এখন তেমন লাভ হচ্ছে না বলে অনেক স্টুডিওর মালিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির দোকান দিচ্ছেন। পাকিস্তান আমলে হাটখোলা এলাকায় ইত্তেফাক পত্রিকা, অভিসার সিনেমা হল, প্যারামাউন্ট প্রেসসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া ব্রিটিশ আমলে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি থাকায় এলাকায় অনেক শ্রমিক-কর্মকর্তা বসবাস করতেন। এসব কারণে স্টুডিও গড়ে ওঠে বলে স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানান।
ফটো ব্যবসায়ী ও ফটো নির্মাতা মো• জহিরুল ইসলাম জানান, ১৯৬৭ সাল থেকে হাটখোলায় ফটো স্টুডিও গড়ে উঠতে থাকে, যার জোয়ার চলে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। ওই সময় সাদাকালো ছবি তোলার জন্য নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন হাটখোলায় জড়ো হতো। রমরমা সেই সময়ে এখানকার যেকোনো স্টুডিওতে ছবি তোলার জন্য গ্রাহকদের সারিতে দাঁড়াতে হতো। ছবি ব্যবসার সেই সোনালি দিন আর নেই বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানান, ২০০০-০১ সালের দিকে ডিজিটাল ফটোগ্রাফি শুরু হলে ‘ম্যানুয়াল’ ক্যামেরার কদর কমতে থাকে। অনেক পুরোনো স্টুডিও বন্ধ হয়ে যায়। টিকে থাকে হাটখোলা স্টুডিও, বীথি স্টুডিও, স্টুডিও-২৭, স্টুডিও এ-১, স্টুডিও পামেলা, মেক্সিকো স্টুডিও, স্টুডিও সোনারগাঁও, পামেলা ফটোগ্রাফার্স, প্রিয়াংকা ফটোগ্রাফার্স, মারলিন ফটোগ্রাফি, ্নরণী স্টুডিও, জাপান স্টুডিওসহ আরও কিছু ছবি তোলার প্রতিষ্ঠান।
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির পাইকারি বাজার
ডিসিসির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের হাটখোলা রোডে রয়েছে দেশের বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির বাজার। নগরের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণের একমাত্র বাজারও এটি। এখানে ছোটবড় প্রায় ২৫০ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক উপকরণের দোকান রয়েছে বলে জানা যায়। এসব দোকানে গবেষণাগারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রি করা হয়। প্যাথলজিতে ব্যবহারের যন্ত্রপাতি ও উপকরণ, অস্ত্রোপচারের জন্য সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় এই বাজারে। টেক্সটাইল ও ডাইংয়ের সব রকম রাসায়নিক উপাদান এ বাজারে বিক্রি করা হয়।
এ বাজারের বেশির ভাগ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক উপকরণ জার্মানি থেকে আমদানি করা হয়। কিছু রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয় ভারত থেকে। এখান থেকে কেউ চাইলেই রাসায়নিক দ্রব্য কিনতে পারে না। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারলে তবেই তা বিক্রি করা হয় বলে জানালেন দোকানকর্মী সুমন।
স্বাস্থ্যসেবায় এনটিআরএস
দুস্থ ও ছিন্নমূল মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে কে এম দাস লেনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জাতীয় যক্ষ্মা ত্রাণ ও পুনর্বাসন সমিতি (ন্যাশনাল টিউবারকিউলোসিস রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সোসাইটি অব বাংলাদেশ)। এনটিআরএস সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ড• জি সি দেব ১৯৬৭ সালে জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তাঁর তিন বিঘা জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি দান করেন। দুই হাজার লোকের আজীবন সদস্যের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি ট্রাস্টি বোর্ড হাসপাতাল পরিচালনা করে। ট্রাস্টের নিজস্ব সম্পত্তি থেকে আয় করা অর্থে হাসপাতালের সব ব্যয় নির্বাহ করা হয়।
বর্তমানে চারজন এমবিবিএস চিকিৎসক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। রোগীদের শুধু ১০ টাকার একটি টিকিট কিনতে হয়। হাসপাতালের পক্ষ থেকে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধও দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে এই হাসপাতালের দান করা জমিতে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি শাখা স্থাপন করা হয়। ধলপুর, গোলাপবাগ, সিটি পল্লী ও স্বামীবাগ এলাকা থেকে গরিব রোগীরা এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে আসে।
এনটিআরএসের সভাপতি ময়নুল হক মঞ্জু বলেন, ‘এ এলাকায় একটি বড় হাসপাতাল দরকার। সরকার বা কোনো সংস্থা যদি হাসপাতাল নির্মাণে এগিয়ে আসে, তাহলে তা নির্মাণ করার জন্য আমরা জায়গা দেব।’
মাদক যেখানে প্রধান সমস্যা
‘আমাদের এলাকাটা ভালোই ছিল। নাগরিক সমস্যা মোটামুটি কম। কিন্তু মাদকসেবী ও মাদক বিক্রেতাদের আনাগোনাই আমাদের এলাকার প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এরা এলাকার যুবসমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’ বলছিলেন আর কে মিশন রোডের বাসিন্দা মকবুল হোসেন।
জানা যায়, এ এলাকার মাদকের প্রধান আখড়া গোপীবাগ এলাকা। মাদক ব্যবসা মূলত রেললাইনকেন্দ্রিক। রেললাইনের পাশের টিটিপাড়া বস্তি থেকে গোপীবাগ মাদ্রাসা এলাকা পর্যন্ত মাদক বিক্রি হয়। রেললাইনের পাশে ঘুরে দেখা গেছে, মাদকসেবীরা মাদক নিচ্ছে। বেচাকেনাও হচ্ছে সেখানেই। মাদক ব্যবসার জের ধরে গত ১৫ নভেম্বর মিন্টু নামের একজন খুন হন।
কে এম দাস লেনের বাসিন্দা জহির বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম দিকে এলাকায় মাদক বিক্রেতা ও মাদকসেবীদের উৎপাত কিছুটা কমেছিল। পুরোনো অনেক মাদক বিক্রেতাকে ধরে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইদানীং বেশ কিছু নতুন মাদক ব্যবসায়ী গজিয়েছে। এদের কারণে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
প্যারামাউন্ট প্রেস থেকে ইত্তেফাক ভবন
হাটখোলার ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইত্তেফাক পত্রিকা ও প্যারামাউন্ড প্রেস। এর মধ্যে ইত্তেফাক-এর প্রথম মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান প্যারামাউন্ট প্রেসটি উঠে গেলেও পত্রিকাটি টিকে আছে। ইত্তেফাক-এর সূচনা হয়েছিল ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক হিসেবে। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন এর প্রধান। তখন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (১৯১১-১৯৬৯ খ্রি•) ভাসানীর প্রধান সহকর্মী হিসেবে পত্রিকা পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বলে জানা যায়।
ঐতিহাসিক প্রকাশনা ঘেঁটে জানা গেছে, ১৯৫১ সাল থেকে ইত্তেফাক-এর পুরো দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মানিক মিয়া। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সাল থেকে আমৃত্যু সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম ছাপা হয়। ৯ হাটখোলা রোডের প্যারামাউন্ট প্রেসে ছিল তাঁর অফিস। সেখানে পত্রিকার কার্যক্রম চলে অনেক দিন। পরে হাটখোলার ১ নম্বর রামকৃষ্ণ রোডে নিজস্ব ভবনে ইত্তেফাক পত্রিকা চলে আসে।
অপরদিকে প্যারামাউন্ট প্রেসটির মালিক হাবিবুর রহমান ইত্তেফাক ছাড়াও মাহে-নও, নওরোজসহ নানা পত্রপত্রিকা মুদ্রণ করতেন। তখনো বিজি প্রেস চালু হয়নি। তাই অনেক সরকারি গেজেট, ফরম ও দলিল-দস্তাবেজও এ প্রেস থেকে ছাপা হতো। হাবিবুর রহমানের মৃত্যুর পর প্রেসটি বেশি দিন টিকে থাকেনি।
বেহাত হচ্ছে মন্দিরের জায়গা
১২ নম্বর কে এম দাস লেনে রয়েছে স্বামী ভোলানন্দ গিরি আশ্রম। পাঞ্জাবের সাধুপুরুষ ভোলানন্দ ১৯২৩ সালে আশ্রমটি গড়ে তোলেন। এ আশ্রমের জন্য সাত বিঘা জমি দান করেছিলেন তাঁরই শিষ্য ও ঢাকার ধনাঢ্য জমিদার যোগেশ চন্দ্র দাস। বর্তমানে আশ্রমটি একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ট্রাস্টি বিশ্বনাথ চৌধুরী জানান, নগরের অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি স্বামী ভোলানন্দ গিরির শিষ্য ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ঐতিহাসিক আশ্রমটি গ্রাস করার নানা ষড়যন্ত্র চলছে। আশ্রমের সাত বিঘা জমির মধ্যে মাত্র তিন বিঘা তাঁদের দখলে রয়েছে। বাকি চার বিঘা অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে বলে তিনি জানান।
সুসং দুর্গাপুরের মহারাজারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাম-সীতার মন্দিরটি। মন্দিরটি ১২০৮ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়। কিন্তু এ মন্দিরকে ঘিরে চলছে নানা অব্যবস্থাপনা। মন্দিরের ছাদ যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। অথচ এর পাশেই রাজউকের নকশাবিহীন মার্কেট নির্মাণের তোড়জোড় চলছে। দোকান বরাদ্দের কয়েক কোটি টাকা কোথায় আছে, তা পূজারিরা জানেন না। এ বিষয়ে রাম-সীতা মন্দির পরিচালনা কমিটির সম্পাদক মদন জানান, সবকিছু সভাপতি গণেশ ঘোষের কাছে জেনে নেবেন।
৪২/২ হাটখোলা রোডে রয়েছে শ্রীশ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু মহাপ্রকাশ মঠ। ১৩২৮ বঙ্গাব্দে স্থাপিত মঠটির অনেক জমি এর আগেই বেহাত হয়ে গেছে। ফরিদপুরের খ্যাতনামা সাধকপুরুষ জগদ্বন্ধু সুন্দরের ্নৃতিকে ধরে রাখার জন্যই ঢাকা মঠ গড়ে তোলা হয়েছে। জগদ্বন্ধু অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করে পুরো ভারতবর্ষে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে উদ্যোগ নেই
‘১৯৯৮ সাল থেকে এ এলাকার বাসিন্দাদের জলাবদ্ধতার সমস্যাটি খুব বেশি ভোগাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার কোনো মাথাব্যথা নেই। অনেক ঘোরাঘুরি করলেও সমস্যা সমাধানে তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’ বলছিলেন কেএম দাস লেনের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী খান বাবু। এলাকাবাসী জানায়, সামান্য বৃষ্টি হলেই এ ওয়ার্ডের কে এম দাস লেন ও আশপাশের রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। বছর কয়েক ধরে বন্ধ হয়ে আছে ১২/১ কে এম দাস লেন থেকে ২০/১ কে এম দাস লেন পর্যন্ত পয়োনালা। এ অংশে কোনো সংস্কারকাজ করা হচ্ছে না। এ ছাড়া এখানে ডিসিসির পানিনিষ্কাশন নালা ও ওয়াসার পয়োনালা এক হয়ে গেছে। এ জন্য বৃষ্টির পানি সরতে পারে না। কে এম দাস লেনের বাসিন্দা ফিরোজ বলেন, ডিসিসির নালা বসানোর জন্য টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সে নালা রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ কারণে এগুলো পরিষ্কার করা হয় না। ফলে ময়লা জমে নালাগুলো ভরাট হয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই এগুলোয় পানি আটকে যায়।
৫২ বছর ধরে চলছে সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ
১৯৫৬ সালের ১ জুলাই মাত্র ৩৪ জন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ। প্রথমে বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। কলেজের প্রথম তহবিলে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৬ হাজার টাকা দান করেছিলেন। পাকিস্তানের ব্যবসায়ী আদমজি দান করেছিলেন ১০ হাজার টাকা। কলেজের শুরু থেকে গড়ে তোলার পেছনে কলেজের প্রথম অধ্যক্ষা বেগমজাদী মাহমুদা নাসির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। একটানা ৩৬ বছর কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
প্রতিষ্ঠার পর বাংলাবাজার সরকারি স্কুল, শক্তি ঔষধালয় ভবন, ওয়াইজঘাটের রায় বাহাদুর পংকজ ঘোষের বাড়ি ও লালকুঠিতে এই কলেজের কার্যক্রম চলেছে। পরে ১৯৬৪ সালের অভয় দাস লেনে ৩ দশমিক ২৫ একর জমি কিনে ১৯৬৬ সালে কলেজের নিজস্ব ভবন নির্মাণ করে সেখানে কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এখানে সুপরিসর নারীশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই কলেজ। বর্তমানে এ কলেজে দুই হাজার ৫৭ জন ছাত্রী পড়ালেখা করছে। এখানে হিসাববিজ্ঞান, ইংরেজি, ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্মাতক-সম্মান এবং ডিগ্রি পাস কোর্স ও চালু আছে। ৭৬ জন শিক্ষক আর ৩১ কর্মচারী রয়েছেন এ কলেজে।
কর্তারা যা বলেন
সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ ও কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের ময়লার কনটেইনার সরানো হবে কি-এ প্রশ্নে ডিসিসির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কনটেইনারগুলো আগে থেকেই এখানে ছিল। এগুলো সরিয়ে নেওয়ার জায়গা না থাকায় সরিয়ে নিতে পারছি না।’
কে এম দাস লেনের জলাবদ্ধতা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ লাইনে আগে আরও বেশি সময় ধরে পানি জমে থাকত। এখন সমস্যা কিছুটা কমেছে। এ এলাকার ময়লা পানি যে পাইপ দিয়ে যায়, সে পাইপটি সরু। এ জন্য ওয়াসাকে জানিয়েছি। তারা বলেছে, পাইপ বসিয়ে দেবে।’
এলাকার মাদক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি-এ প্রশ্নে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফাজ্জল হোসেন দাবি করেন, ‘আগে এলাকাটি মাদকের গোডাউন ছিল বলা যায়। তবে এখন অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। এখন কেউ প্রকাশ্যে মাদকদ্রব্য বিক্রি করতে পারে না। আমাদের সাদা পোশাকের সদস্যরা সব সময় টহল দিচ্ছে। আমরা মাদক বিক্রেতাদের প্রায়ই ধরছি, মামলা দিচ্ছি।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৮
Leave a Reply