ঢাকা পৌরসভার প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৮৮৪ সালের ২৪ নভেম্বর। বিদেশি চিন্তাধারার ভিত্তিতে গঠিত স্থানীয় এ স্বায়ত্তশাসন পদ্ধতির সূচনাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, এটা শুধু ঢাকা পৌরসভার প্রথম নির্বাচনই ছিল না, ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রথম ও সর্ববৃহৎ নির্বাচন। তা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন, শহরের শিক্ষিত ও ধনাঢ্য মহল এবং জনসাধারণ তৃণমূল পর্যায়ের একটি গণতান্ত্রিক ধারা খুঁজে পেল। ১৮৬৪ সালে ঢাকা পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর তা ইংরেজ প্রশাসনের মর্জিমতো পরিচালিত হতো বলে এতে সাধারণ জনগণের মতামত প্রতিফলিত হতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড• শরীফ উদ্দিন আহমেদের বিবরণ থেকে এসব তথ্য জানা গেল।
এ ব্যাপারে ঢাকার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ড• মুনতাসীর মামুনের বিবরণ থেকে জানা গেছে, ১৮৮৪ সালের আগ পর্যন্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকারবলে পৌরসভার সভাপতি হতেন। ভাইস চেয়ারম্যান নিয়োগ করতেন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর। বিভাগীয় কমিশনার, ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাহী প্রকৌশলী ও সিভিল সার্জন ছিলেন পদাধিকারবলে কমিটির সদস্য। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্কিনার ও ঢাকা কলেজের শিক্ষক জর্জ বিলাট ছিলেন ঢাকা পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান।
ঢাকা পৌরসভার নির্বাচনী প্রথা চালু হওয়ার সূচনায় প্রথমে নির্বাচিত হতেন পৌর কমিশনাররা। তাঁদের ভোটে মনোনীত হতেন পৌরসভার চেয়ারম্যান। তবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত কমিশনারদের মধ্য থেকেই চেয়ারম্যান নির্বাচন করার জন্য ভোটাভুটি হতো। এ পদ্ধতিতেই ঢাকার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছিলেন ঢাকার প্রখ্যাত আইনজীবী আনন্দচন্দ্র রায়। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নবাব পরিবারের খাজা আমিরুল্লাহ।
ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গেছে, একসময় ঢাকা পৌরসভা সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জনগণের কাছ থেকে কর আদায়ের কৌশল হিসেবে স্থানীয় লোকদের পৌর প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাঁরা অধিকাংশই ছিলেন ব্রিটিশদের অনুগত এ দেশীয় সহচর। অপরদিকে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে পৌর চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের জন্য ঢাকাবাসীর একটি শক্তিশালী অংশ দাবি করে আসছিল। ঢাকা জনসাধারণ সভা নামের একটি বৃহৎ সংগঠন এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকে। সভার পক্ষ থেকে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে ঢাকায় নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তনের আবেদন জানিয়ে একটি দাবিনামা পেশ করা হয়। ঢাকা ইতিহাস ও নগর জীবন বইয়ের এক বিবরণ থেকে জানা গেছে, ঢাকা জনসাধারণ সভার নেতৃত্বে ছিলেন উকিল ও জমিদার আনন্দচন্দ্র রায়, রমাকান্ত নন্দী, গোপীমোহন বসাক, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন ঘোষ, জমিদার ব্রজেন্দ্র কুমার রায়, ধনাঢ্য ব্যাংকার রূপলাল দাস প্রমুখ। পাটুয়াটুলীর ইস্টবেঙ্গল থিয়েটার হলে তাঁরা সভা-সমিতি করে ভোটের দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন। ওই সময় ঢাকা প্রকাশ পত্রিকা ও ঢাকা জনসাধারণ সভা সংগঠনটিকে পরিচালনা করতেন কিছু দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ।
ড• শরীফ উদ্দিন আহমেদের মতে, ঢাকা জনসাধারণ সভার উদ্যোগে প্রায় ৭০০ নগরবাসীর স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র ১৮৭৪ সালের ২৪ জুন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পলের কাছে পাঠানো হয়। এ আবেদনপত্রে অনুরোধ করা হয়, তিনি যেন শিগগিরই বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি কমিশনার নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করেন। আবেদনপত্রটি তথাকথিত ঢাকা জনসাধারণ সভা কর্তৃক অনুপ্রাণিত-এই অভিযোগে তা বাতিল করে দেন রিচার্ড টেম্পল। ১৮৮২ সালের ১৮ মে লর্ড রিপন তাঁর বিখ্যাত স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব পেশ করলে ঢাকার সর্বস্তরের জনগণ তাঁর পক্ষ নেয়। কিন্তু তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিভার্স থমসন ছিলেন লর্ড রিপনের প্রস্তাববিরোধী। এর প্রতিবাদস্বরূপ ও লর্ড রিপনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য ১৮৮২ সালের ২৪ জুলাই পুরান ঢাকার তৎকালীন জগন্নাথ স্কুল (পরে জগন্নাথ কলেজ) প্রাঙ্গণে একটি বিশাল জনসভা আয়োজন করে ঢাকা জনসাধারণ সভা। এ সভায় প্রায় ২০ হাজার নগরবাসী সমবেত হয়েছিল, যা ছিল ্নরণকালের সবচেয়ে বড় জনসভা। সংগঠনের সভাপতি ব্রজেন্দ্র কুমার রায়ের সভাপতিত্বে হওয়া অনুষ্ঠানে পৌরসভাসহ অন্যান্য স্থানীয় সংস্থা ও সংগঠনে নির্বাচনী ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করা হয়। সেখানে প্রস্তাব করা হয়, নির্বাচিত সদস্যরাই পালাক্রমে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদ দুটির নির্বাচন সম্পন্ন করবেন।
ধীরে ধীরে এ আন্দোলনের সুফল ফলতে থাকে। এ প্রসঙ্গে ১৮৮২ সালের ৫ জুলাই ঢাকার ভারপ্রাপ্ত জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট এ সি টিউটের মন্তব্য, ‘•••যদি কোনো বাঙালি গোষ্ঠীকে যোগ্য বিবেচনা করে নির্বাচনী ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে তারা হবে ঢাকার অধিবাসী। কেননা এটি হচ্ছে পূর্ববাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। এখানে এত অধিকসংখ্যক শিক্ষিত, বিত্তবান এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর লোক বাস করে, যা আমার অভিজ্ঞতায় ভারতবর্ষের আর কোনো পৌর এলাকায় আমি লক্ষ করিনি।’
এ দেশীয় ও কয়েকজন ব্রিটিশ আমলার গ্রহণযোগ্য যুক্তি বিবেচনা করে অবশেষে ১৮৮৪ সালে ৩ নম্বর অ্যাক্ট পাস করা হয়, যে অ্যাক্টে পৌরসভার কমিশনারদের দুই-তৃতীয়াংশের নির্বাচনের বিধান করা হয়। একই সঙ্গে সারা দেশে পৌরসভার মধ্যে তফসিলভুক্ত শুধু ২৬টি বাদে বাকি সব কটি স্থানে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনেরও অনুমতি দেওয়া হয়। এ আইন প্রণয়নের ফলে পৌরসভার গঠন কাঠামো কিছুটা পরিবর্তিত হয়। এ কাঠামোয় ঢাকার ২১ জন কমিশনারের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১৪ জন কমিশনারকে নির্বাচিত হতে হয়। ফলে ওয়ার্ড পুনর্গঠনের মাধ্যমে সাতটি করা হয়। তা ছাড়া যেসব ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক ও অন্তত এক বছর ধরে পৌর এলাকায় বসবাস করছেন তাঁরাই ভোটার হয়েছিলেন। এ ছাড়া যে শিক্ষিত ব্যক্তি, উকিল, চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মাসে কমপক্ষে ৫০ টাকা আয় করেন ও কোনো যৌথ পরিবারের একজন সদস্যও যদি পৌরকর পরিশোধের সামর্থ্য রাখেন, তবে তাঁদের ভোটার করা হয়। সে সময় ঢাকার লোকসংখ্যা ৮২ হাজার ২১০ জনের মধ্যে তালিকাভুক্ত ভোটার হয়েছিলেন সাত হাজার ২০২ জন, যা মোট জনসংখ্যার নয় শতাংশ।
ঢাকার প্রথম পৌর নির্বাচনে ১৪টি কমিশনার পদে ১১৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তাঁদের কোনো দল, উপদল কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। তবে প্রত্যেক প্রার্থীরই কিছু অনুগত সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল। তবে ঢাকার ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ফ্রাঙ্ক হান্টার ব্যারো মন্তব্য করেছিলেন, ঢাকার প্রথম নির্বাচনে কোনো রাজনীতি কিংবা দল না থাকলেও একটি মোর্চা গঠিত হয়েছিল। সে মোর্চার নেতৃত্বে ছিল ঢাকা জনসাধারণ সভা। ঢাকার প্রথম ভোট অনুষ্ঠানটি বেশ বর্ণাঢ্য হয়েছিল। মিছিল, ভোট প্রার্থনা সভা, ভোটারদের আপ্যায়ন থেকে শুরু করে যাতায়াতের জন্য গাড়ি ভাড়াও করা হয়েছিল। তবে ১১৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ২২ জন। এর মধ্যে ১৪ জন জয়ী হয়েছিলেন। ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল নর্থব্রুক হল, ইস্টবেঙ্গল থিয়েটার হল, পুরানা পল্টন ময়দান, লালবাগ চত্বর, চকবাজার, বংশাল, আরমানিটোলাসহ আরও কয়েকটি এলাকা।
৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থীদের সমঝোতার কারণে ভোট হয়নি। ভোটে জয়ী প্রার্থীরা হলেন ১ নম্বর ওয়ার্ডে রূপলাল দাস, পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি ও খাজা আমির উল্লাহ, ২ নম্বর ওয়ার্ডে রাধিকামোহন বসাক ও রমাকান্ত নন্দী, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে চন্দ্রমোহন বসাক ও মৌলভী রেজা করিম, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ ও হাজী আব্দুর রশীদ, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আনন্দচন্দ্র রায় ও সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ হায়দার বকস এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রজেন্দ্র কুমার রায় ও কৈলাসচন্দ্র দাস। এর মধ্যে কমিশনার খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ ও সৈয়দ গোলাম মোস্তফাকে নির্বাচনী বৈধতা না থাকার কারণে পদচ্যুত করা হয়। অপরদিকে কমিশনারদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আনন্দচন্দ্র রায় ১৮৮৫ সালের ২০ এপ্রিল ঢাকা পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৮
Leave a Reply