ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রজ্জব আলী। তাঁর মাথা ও শরীরে জাতীয় পতাকা জড়ানো। জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজানো সাইকেলের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। নির্বাচন উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য সারা দেশ সফর করবেন রজ্জব আলী। তিনি জানান, ১৯ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তখন তিনি ছিলেন কলেজের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোরবানির ঈদের দিন তাঁরা দাউদকান্দিতে যুদ্ধ করছিলেন। যুদ্ধের ফাঁকে গ্রামের লোকজন তাঁদের খাওয়াচ্ছিল। অতর্কিতে পাকিস্তানি সেনারা চারদিক থেকে তাঁদের আক্রমণ করে। ওই যুদ্ধে রজ্জব আলীর অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। রজ্জব আলীর সঙ্গে ছিলেন সহযোদ্ধা ও বন্ধু রফিক। একসময় খেয়াল হলো, রফিক মরে পড়ে আছে। রজ্জব আলী বলেন, ‘কখন গুলি লেগেছে, কখন মরেছে বুঝতে পারি নাই। স্বাধীনতার পরে দাউদকান্দির এই জায়গাটার নাম রাখা হয়েছে শহীদনগর।’
রজ্জব আলীর এক চাচা ছিলেন জাহাজের সারেং। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তার অধীনে সহকারী সুকানি হিসেবে চাকরি নেন রজ্জব। দুই বছর পর তিনি এমভি মুরাদ নামের একটি নৌযানের সারেং হন। জাহাজ চালানোর সময়ই ১৯৭৫ সালে খবর পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। সকালবেলা রজ্জব আলী জাহাজে বসে মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন। রজ্জব আলী বলেন, ‘আজও মাংস-ভাত খাই না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমি ভাত-মাংস খাব না। এখন রুটি, পাউরুটি, মুড়ি-চিঁড়া খাই। আমার অভ্যাস হইয়া গেছে। আগে বউ রুটি বানাইয়া দিত। এখন ছেলের বউরা বানায়। আবার দোকান থেইকাও রুটি-ভাজি কিন্না খাই।’
রজ্জব আলীর বাড়ি মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার হাসাইল গ্রামে। তাঁর বাড়িঘর সব পদ্মানদী ভেঙে নিয়ে গেছে। ২৫ বছর তিনি জাহাজে সারেংয়ের কাজ করেছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে আর সারেংয়ের কাজ করেন না। তার দুই ছেলে ভাঙারির ব্যবসা করে। তাদের সঙ্গেই মুগদাপাড়ায় থাকেন রজ্জব আলী। তিনি জানান, তিনি নিজে যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে মাছ কিনে ফেরি করে বিক্রি করেন বাসাবো এলাকায়। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন ছয়-সাত বছর আগে। রজ্জব আলী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান। এ জন্য মাঝে মাঝে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘ত্রিশ লাখ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলো, আর শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে রাজাকার নিজামী-মুজাহিদরা গাড়ি চালাইয়া যায়। এইটা হয় কেমনে? ভাইরে, শরীরের রক্ত ফাল পারে, আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সবাইরে এই কথা জানাইতে চাই।’
মাসুক হেলাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৮
Leave a Reply