একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর মূল টার্গেটে পরিণত হয় হিন্দু-অধ্যুষিত মহল্লা শাঁখারীবাজার। ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে পাঁচ মাসের শিশুসন্তান পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি। মহল্লার প্রতিটি ঘরে ঘরে চালানো হয়েছিল ব্যাপক লুটপাট। আর অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গিয়েছিল সবকিছু। নগরের আর কোথাও এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়নি। এতে নিহত হয় প্রায় অর্ধশত শাঁখারী সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ-শিশু। প্রায় ২০০ শাঁখারী আহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মহল্লাটির নাম বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে দেশ-বিদেশে। পার্শ্ববর্তী জগন্নাথ কলেজ ও ব্রাহ্মসমাজে পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। ২৬ মার্চ থেকেই শাঁখারীবাজারে পাক বাহিনী ও এ দেশীয় দোসরদের হামলা শুরু হয়। ফলে মহল্লার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। ২৮ মার্চের মধ্যে কোনো একজন মানুষও শাঁখারীবাজার মহল্লায় খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই জানান।
শাঁখারীবাজারের প্রবীণ বাসিন্দা দীপকনাথ নন্দী জানান, মহল্লা থেকে প্রাণভয়ে লোকজন বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে জিনজিরা গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু ২ এপ্রিল ‘অপারেশন কেরানীগঞ্জ’ নামে পাক হানাদার বাহিনীর এক বর্বরোচিত হামলায় শত শত নিরীহ মানুষ মারা যায়। এতে শাঁখারীবাজার থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া বেশকিছু লোকও ছিল। শাঁখারীবাজার নাগরিক কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ্নরণিকা সূত্রে জানা যায়, একাত্তর সালে শাঁখারীবাজারের রাস্তাঘাটে বৃদ্ধ ও শিশুদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তা তুলে নিয়ে গিয়ে সৎকার করার মতো লোক পাওয়া যায়নি। হানাদারদের গুলি আর বেয়নেটের আঘাতে শহীদ হয় ৫১ নম্বর শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা চানধন সুর (৫২) ও ৬৩ নম্বর শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা আড়াই বছর বয়সী বুদ্ধদেব সুর। তাদের লাশ মহল্লার মধ্যেই পড়ে ছিল। তা ছাড়া ৪০ শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা একই পরিবারের চারজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী জল্লাদেরা। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ্নরণিকায় একাত্তরে শহীদ ৪৩ জনের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এসব শহীদ ছাড়াও অনেক অজ্ঞাত লোক তখন নিহত হয়েছিল বলে জানা যায়।
শাঁখারীবাজারের আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস শাঁখারীবাজার পাক হানাদার, বিহারি অবাঙালি ও দেশীয় রাজাকারদের দখলে ছিল। জনমানবশূন্য মহল্লার প্রতিটি ঘরে ঘরে তারা লুটতরাজ চালায়। নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র তারা নিয়ে যায়। প্রাচীন জনপদ শাঁখারীবাজারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় টিক্কা খান রোড। এ টিক্কা খান ছিল বাঙালি হত্যাযজ্ঞের অন্যতম হোতা।
ষোলই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেঁচে যাওয়া শাঁখারীরা মহল্লায় ফিরে আসতে থাকে। তারা এসে দেখে, পুরো মহল্লা মৃতপুরীতে পরিণত হয়েছে। বাড়িঘরের কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। রান্নার জন্য একটি হাঁড়ি কিংবা বসার জন্য একটি জলচৌকিও খুঁজে পায়নি তারা। এমনকি মহল্লার প্রতিটি মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। দেব-দেবীর আরাধনা করার মতো দেবমূর্তি কিংবা সরঞ্জাম তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। নিঃস্ব ও অসহায় মানুষগুলো শূন্য থেকে নতুন জীবন শুরু করে। দেশ স্বাধীনের পরও তাদের নিরাপত্তা বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। ‘৯০ সালের অক্টোবর ও ‘৯২ সালের ডিসেম্বর দুবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামে শাঁখারীবাজারে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। পুড়ে দেওয়া হয় দোকানপাট। বাড়িঘরে লুটপাট চালানো হয়।
শাঁখারীবাজারের প্রবীন বাসিন্দা অমিয় কুমার সুর মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তিনি জানান, ‘৭১ সালে স্থানীয় রাজাকার, বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শাঁখারীবাজারে প্রতিটি বাড়ি ও কক্ষে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ ওই এলাকায় থাকতে পারেনি। রাস্তায়, ঘরে শুধু লাশ আর লাশ পড়েছিল।
৪৭, শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা অমর সুর জানান, স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর পরিবারের বাবা-ভাই-বোনসহ তিনজন নিহত ও এক বোন আহত হন। কিন্তু ‘৭২ সালে শহীদ পরিবারের জন্য দুই হাজার টাকা দেওয়ার শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা ছাড়া তাঁরা আর কোনো মূল্যায়ন পাননি। ওই টাকাও তাদের হাতে আসেনি। শাঁখারীবাজারের গণহত্যায় যারা ক্ষতিগস্ত হয়েছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। যেসব শাঁখারী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাঁরাও মূল্যায়ন পাননি। শাঁখারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ৩০-৪০ জন। এঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সুদীপ দাস, মদন সিংহরা কীভাবে বেঁচে আছেন তার কোনো খোঁজ নিতে কেউ আসেনি।
শাঁখারীবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক শাঁখারী জিনজিরায় আত্মগোপন ও সীমান্ত পার হতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন। তাঁদেরও কোনো পরিসংখ্যান নেই। শুধু ১৯৭২ সালে শাঁখারীবাজারের পুর্বপ্রান্তে ছোট্ট একটি ্নৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে স্থানীয়দের উদ্যোগে। স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব ও ত্যাগের মূল্যায়ন চান না। কিন্তু বেঁচে থাকার নিরাপত্তা চান।
আপেল মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৮
Leave a Reply