ট্যানারি বর্জ্যে হাজারীবাগ, রায়েরবাজার, জিগাতলা ও ধানমন্ডির কিছু এলাকার বাতাসে ভর করেছে বিষ, পানি হয়ে পড়েছে দূষিত। এলাকাগুলোর আবাসিক বাসিন্দারা দূষিত পরিবেশের কারণে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আবাসিক এলাকার পরিবেশদূষণ রোধে হাজারীবাগ ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের জন্য ‘চামড়া শিল্পনগরী, সাভার’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০০৩ সালে। পাঁচ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি সেই প্রকল্প। ভিনদেশি চামড়ার ক্রেতারা সংশ্লিষ্টদের বলেছেন ২০১০ সালের মধ্যে পরিবেশবান্ধব উপায়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ নিশ্চিত করতে। ওই সময়ের মধ্যে সাভারে আধুনিক চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা চালু না হলে চামড়া রপ্তানির বিষয়টি হুমকির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু সাভারে বর্জ্য শোধনাগার-সিইটিপি (কমন ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) এখনো নির্মাণ করা হয়নি বলে ট্যানারিগুলো সেখানে সরিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। হাজারীবাগ ট্যানারির পরিবেশদূষণ ও ‘চামড়া শিল্পনগরী, সাভার’ প্রকল্প বাস্তবায়নের বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন ওবায়দুর রহমান মাসুম
হাজারীবাগে পরিবেশদূষণ চলছেই
হাজারীবাগ যাওয়ার পথে জিগাতলা পৌঁছাতেই ট্যানারি বর্জ্যের কটু গন্ধ নাকে লাগল। জিগাতলা থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি মোড়ে গেলে দুর্গন্ধের তীব্রতা আরও বাড়ল। নাকে রুমাল চেপেও দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পাওয়া গেল না। হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার ভেতর দিয়ে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত যেতে আরও ভয়াবহ দুর্গন্ধের মুখোমুখি হতে হলো। হাজারীবাগ এলাকায় প্রায় ১৯৫টি ছোটবড় ট্যানারি রয়েছে। এসব ট্যানারির বর্জ্য বর্জ্য নালা দিয়ে গিয়ে পড়ছে বেড়িবাঁধের পাশের খালে। খাল ভরে আছে ট্যানারি শিল্পবর্জ্যে। বেড়িবাঁধ এলাকার রাস্তার পাশে বিভিন্ন স্থানে চুলা বসিয়ে তাতে চামড়ার উপজাত দ্রব্য পোড়ানো হচ্ছে। এসব উপজাত দ্রব্যের পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। এ ছাড়া রাস্তার পাশেই চামড়ার বিভিন্ন উচ্ছিষ্টাংশ শুকাতে দেওয়া হয়েছে। বাবুবাজার-আমিনবাজার রুটের ব্রাদার্স পরিবহনের একটি বাসের যাত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আসলে মনে হয় দোজখের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। নাকে রুমাল চাপলেও থাকতে পারি না। দুর্গন্ধে বমি চলে আসে।’ এলাকার লোকজন থাকে কীভাবে? এ প্রশ্নে হাজারীবাগ মনেশ্বর লেনের বাসিন্দা রাশেদুল হাসান বলেন, ‘ট্যানারিগুলোর কারণে এই এলাকায় সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। পচা দুর্গন্ধের মধ্যে থাকতে থাকতে আমাদের ঘ্রাণশক্তি কমে গেছে।’ এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই চর্মরোগে ভুগছে। এ ছাড়া অনেকে জ্বর, কাশি, হাঁপানি, পাকস্থলীর রোগে ভুগছে বলে তিনি জানান।
হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দারা জানান, ট্যানারিগুলো থেকে নির্গত রাসায়নিকের প্রভাবে জানালার গ্রিল ক্ষয়ে যায়। এ ছাড়া স্বর্ণ ও রুপার অলংকার নষ্ট হয়ে যায়। টেলিভিশন, ফ্রিজ, কম্পিউটার, এয়ার কন্ডিশনারের মতো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বেশিদিন টেকে না বলে তারা জানায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, ট্যানারিগুলোয় চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে প্রায় ৩০ ধরনের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। এ জন্য অশোধিত এসব বর্জ্য মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব তরল বর্জ্য নালা ও খাল হয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশে। এই বিষাক্ত বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানি মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। এ ছাড়া কাঁচা ও প্রস্তুতকৃত চামড়ার উচ্ছিষ্ট, চুল ও মাংসের উচ্ছিষ্টসহ নানা রকম শিল্পবর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ট্যানারি-বর্জ্য বুড়িগঙ্গার নাব্যতাও হ্রাস করে দিচ্ছে।
হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য হাজারীবাগ, রায়েরবাজার, জিগাতলা ও ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দারা বহুদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো• হারুন চৌধুরী বলেন, ‘এই এলাকা থেকে ট্যানারিগুলো সরিয়ে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।’
বর্জ্য শোধনাগারের অভাবে চালু হচ্ছে না চামড়া শিল্পনগরী
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী সভায় (একনেক) ‘চামড়া শিল্পনগর-সাভার, ঢাকা’ নামের একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের জন্য ১৭৫ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা অনুমোদন করে একনেক। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিসিককে। ২০০৫ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১০ পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের নতুন ব্যয় ধরা হয় ৫৪৫ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য সাভারের হরিণধরা এলাকায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন করে সেখানে ১৯৫টি শিল্প প্লট বানিয়ে তা ট্যানারি মালিকদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ট্যানারির মালিকেরা প্লটের একটি কিস্তির টাকাও পরিশোধ করেছেন বলে জানা গেছে।
সাভারের প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ট্যানারি শিল্প এলাকায় রাস্তা ও পানি নিষ্কাশন নালা নির্মাণ এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। অগ্নি নির্বাপণব্যবস্থার জন্য ফায়ার সার্ভিসের অফিস ভবন বানানো হয়েছে। কিন্তু এখনো সেখানে বর্জ্য শোধনাগার-সিইটিপি (কমন ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) নির্মাণ করা হয়নি। সব অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলেও শুধু শোধনাগার নির্মাণ করতে না পারায় ট্যানারি শিল্পকারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তর করা যাচ্ছে না বলে জানালেন বিসিকের একজন কর্মকর্তা।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, সিইটিপি নির্মাণের টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে দুই বছর ধরে। প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করলেও দরদাতাদের কাছ থেকে কোনো রকম সাড়া পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার মাত্র একটা দরপত্র জমা পড়েছে। তৃতীয়বার দরপত্র আহ্বান করলে বেশ কিছু দরপত্র জমা পড়ে। কিন্তু প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে না পারায় এসব দরপত্রের কোনোটিই গ্রহণ করা হয়নি। এখন চতুর্থবারের মতো দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন বিসিকের একজন কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে ঢাকা চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো• আবুল কাশেম বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে টেন্ডার আহ্বান ও অন্যান্য কাজ শেষ করে কার্যাদেশ দিতে পারলে ২০১০ সালের মধ্যেই বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের কাজ শেষ করা যাবে।’
বাংলাদেশ ফিনিশ্ড লেদার, লেদার গুড্স অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আনসারী বলেন, ‘হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প সরিয়ে নিতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। ট্যানারি মালিকদের পক্ষে এই বিপুল পরিমাণ ব্যয় বহন করা কঠিন। সরকার সহযোগিতা না করলে ট্যানারিগুলো সরিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’
হুমকির মুখে চামড়াশিল্প
সংশ্লিষ্টদের মতে, হাজারীবাগ ট্যানারিগুলোয় কোনো বর্জ্য শোধনাগার না থাকায় তা পরিবেশ দূষিত করছে। আর এমন আবাসিক এলাকার কাছে ট্যানারি থাকা উচিত নয় বলে তারা মনে করে। এদিকে বিদেশি ক্রেতারাও পরিবেশ দূষণ না করে চামড়া উৎপাদনের তাগিদ দিয়ে আসছে।
এ বিষয়ে একাধিক ট্যানারি মালিক জানান, ২০১০ সালের মধ্যে পরিবেশবান্ধব উপায়ে চামড়া উৎপাদন না করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনবে না। বে ট্যানারিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুর রহমান বলেন, ‘সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের জন্য খুব ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। চীন ও ভিয়েতনাম থেকে আন্তর্জাতিক জুতা তৈরির বেশ কিছু কারখানা বাংলাদেশে চলে আসছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি কারখানা স্থাপনের কাজও শুরু হয়েছে। তবে ২০১০ সালের মধ্যে ট্যানারিগুলো সাভারে নিয়ে যেতে না পারলে তা বাংলাদেশি চামড়াশিল্পের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। চামড়াশিল্পকে ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব ট্যানারিগুলো সাভারে সরিয়ে নিতে হবে।’ এ জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে বলে ট্যানারি মালিকেরা জানান।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৮
Leave a Reply