ক্রেতাদের কাছ থেকে রপ্তানি কাজ পাওয়ার পর দেশের পোশাক কারখানাগুলো মালিক সমিতির (বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ) কার্যালয় থেকে একটা সনদ বা ঘোষণাপত্র নিয়ে থাকে, যাকে বলা হয় ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন-ইউডি। ইউডিতে রপ্তানির জন্য আমদানি, স্থানীয় মূল্য সংযোজন, কাপড়ের ব্যবহার ইত্যাদি তথ্য উল্লেখ করা থাকে। রপ্তানির বিপরীতে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা পেতে, আমদানি ও রপ্তানির জন্য বন্দর ও শুল্ক কর্তৃপক্ষকে ইউডি দেখাতে হয়।
ইউডির হিসাব থেকেই প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায় রপ্তানির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসের ইউডির উপাত্ত বিশ্লেষণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে এখন পর্যন্ত কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।
নভেম্বর মাসের ইউডির তথ্য থেকে দেখা যায়, দুই সমিতি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ উভয়ই নভেম্বর মাসে অক্টোবরের এবং আগের বছরের নভেম্বরের তুলনায় বেশি পরিমাণ ইউডি ইস্যু করেছে। সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপাত্ত দিয়ে জানান, গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার প্রভাব পড়েছে এমন কোনো তথ্য এখনো মেলেনি।
বিজিএমইএর উপাত্তে দেখা যায়, গত নভেম্বর মাসে দুই হাজার ৬৩১টি ইউডি ইস্যু করেছে সংস্থাটি। অক্টোবর মাসে ইউডি ইস্যুর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ১৩০টি। আর আগের অর্থাৎ ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউডি ইস্যু হয়েছিল দুই হাজার ৪৪৫টি। অন্যদিকে বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালের নভেম্বরের তুলনায় ইউডি ইস্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে তিন শতাংশের মতো এবং চলতি বছরের অক্টোবরের তুলনায় ইউডি ইস্যু খানিকটা বেড়েছে।
তবে রপ্তানিকারকেরা বলছেন, কিছু রপ্তানিকাজ দেরিতে জাহাজীকরণ করার অর্থাৎ কাজ শেষ হলেও তা এক-দুই মাস দেরি করে পাঠানোর অনুরোধ ক্রেতাদের কাছ থেকে তারা পেয়ে চলেছেন। নামীদামি কয়েকটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান তাদের রপ্তানিকাজ আস্তে-ধীরে করতেও অনুরোধ করেছে। মালিকদের সূত্রগুলো জানায়, ওয়ালমার্ট, জেসিপেনির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানিকারকদের দেরিতে পণ্য পাঠানোর অনুরোধ করছে।
দেরিতে রপ্তানি করার এসব অনুরোধ ইউডির হিসাবে ধরা পড়বে না। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর-ইপিবি রপ্তানি তথ্য দেখলে ধারণা করা যেতে পারে। তবে বিশ্ব অর্থনীতিতে চলতে থাকা মন্দা এখনো বাংলাদেশের রপ্তানিতে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি বলে রপ্তানিকারক দুই সমিতির নেতারা ধারণা করছেন।
বিজিএমইএ সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, নভেম্বর মাস পর্যন্ত রপ্তানির হিসাব ঠিকই আছে, প্রবৃদ্ধিও ভালো বলা যাবে। কিন্তু ডিসেম্বর ও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কী দাঁড়ায় সেটা দেখতে হবে।
প্রায় একই রকম মত বিকেএমইএর সভাপতি ফজলুল হকের। তিনি বলেন, মন্দার কিছু বাতাস এসে থাকতে পারে। রপ্তানির পণ্য দেরিতে নিতে ক্রেতাদের ইচ্ছার মধ্যে সেই বাতাস লক্ষ করা যাচ্ছে।
আবার কোনো কোনো ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান রপ্তানি মূল্যের অর্থ পুরো পরিশোধ করে দিয়েও বাংলাদেশেই পণ্য রেখে দিতে চাইছেন। তাতে নিজ দেশের গুদামে পণ্য ফেলে রাখার খরচ সাশ্রয় হবে।
বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর সভাপতিরাও জানান, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের আসন্ন বড়দিনে এবার বিক্রি কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আগামী বছর হয়তো গুদামে থাকা পণ্যই বিক্রি হবে। ফলে রপ্তানি কমে যেতে পারে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে ক্রেতারা ইতিপূর্বে নির্ধারিত মূল্যের ওপর নতুন করে ছাড়ও চাচ্ছে। যেমন টেসকো জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে তাদের যেসব কাজ আছে তাতে দুই শতাংশ করে ছাড় দিতে হবে।
এদিকে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার প্রভাব পড়ার শুরুতে, বিশেষত চীন থেকে প্রচুর পরিমাণ রপ্তানির কাজ প্রত্যাহার করে বাংলাদেশে চলে আসতে শুরু হয়েছিল। ওয়ালমার্ট, এইচ অ্যান্ড এম, ভিএফ করপোরেশন, ক্যারিফোরের মতো অনেক বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান চীনের পরিবর্তে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতে রপ্তানি কাজ দিচ্ছিল। এসব কাজ আগে দেওয়া হতো চীন, ভারত, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া বা কম্বোডিয়াকে। এখন এর কিছু কাজ ভারতে চলে যাচ্ছে বলে রপ্তানিকারক সূত্রগুলো জানায়।
আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘ভারত মূল্য প্রতিযোগিতায় আমাদের পিছনে ঠেলে দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ভারতের মুদ্রা রুপির বড় দরপতন করেছে সে দেশের সরকার। এর পাশাপাশি সেখানে রয়েছে পোশাকের সব ধরনের পশ্চাৎ সংযোগশিল্প। সুতার দাম কমে গেছে ১৫ শতাংশ আর কাপড়ের দামও কমেছে অনেকখানি। ফলে ক্রেতারা সেখানে মূল্য ছাড় পেয়ে বেশ কিছু কাজ বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারতে দিচ্ছে, আগে যেগুলো চীন থেকে বাংলাদেশে আসছিল।
জনাব পারভেজ বলেন, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি নিয়ে তাঁরা আশাবাদী। বড় বড় ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে দ্বিগুণ কাজ নিতে চায়। বিজিএমইএ মাস দুয়েক আগে বিশ্বের বড় বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে বর্তমানের দ্বিগুণ পরিমাণ রপ্তানি কাজ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু তারা কতকগুলো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রত্যাশা করেছে।
ক্রেতারা বৈঠকে বিকল্প সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ যেকোনো কারণে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ হয়ে পড়লে বিকল্প ব্যবস্থা থাকে। এ ছাড়া ক্রেতারা তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক দক্ষ লোকবল না থাকায় বিদেশ থেকে লোকবল আনা, সে ক্ষেত্রে ওয়ার্ক পারমিট দেওয়ার জটিলতা দূর করা, ক্রেতাদের জন্য পাঁচ বছরের মাল্টিপল ভিসার ব্যবস্থা করা, ইন্টারনেট সংযোগ ফি কমানো এবং এ দেশে কর্মরত বিদেশিদের উপার্জিত অর্থ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত দেশে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছে। জনাব পারভেজ বলেন, ‘আমি প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ দাবি তুলে ধরেছি।’
একই রকম তথ্য দেন ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা সমীক্ষা করেছি। তাতে দেখা যাচ্ছে, নানা কারণে ক্রেতারা চীন থেকে তাদের গতি পরিবর্তন করতে চায়। আর সে গতির একটা লক্ষ্য অবশ্যই হলো বাংলাদেশ। ফলে বড় এক সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে।’
মনজুর আহমেদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৮
Leave a Reply