চামড়া বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত। প্রতিবছরই প্রক্রিয়াজাত চামড়ার পাশাপাশি চামড়া নির্মিত পাদুকাসহ বিভিন্ন সামগ্রী (যেমন হাতব্যাগ) বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে। আর এসব পণ্য রপ্তানির মৌলিক উপাদান পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয় কোরবানি ঈদের সময়ে। সারা বছর যে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তার প্রায় ৯০ শতাংশই হয় কোরবানি ঈদের উৎসর্গ করা গরু, ছাগল, খাসি প্রভৃতি পশু থেকে। সে হিসেবে কাঁচা চামড়ার খুচরা ব্যবসা একটি মৌসুমি ব্যবসা। বছরের বাকি সময়ে প্রক্রিয়াকারক ও রপ্তানিকারকেরা ব্যস্ত থাকেন চামড়া প্রক্রিয়াজাত এবং এ থেকে বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিতে। তবে কোরবানি ঈদের মৌসুমে তাঁরা নজর দেন চামড়া সংগ্রহের দিকে।
এবারের কোরবানি ঈদ মৌসুমে অন্যান্য বছরের তুলনায় অধিক পরিমাণে পশু কোরবানি হয়েছে। তাই চামড়ার জোগান স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে। আবার অন্য বছরগুলোর তুলনায় চামড়ার দামও অনেক কম। সুতরাং, চামড়ার সংগ্রহের খরচ গতবারের অর্ধেক হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়টি গোটা চামড়াশিল্প খাতে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলার কথা।
কিন্তু প্রক্রিয়াকারক ও রপ্তানিকারকেরা এর বদলে শোনাচ্ছেন আশঙ্কার কথা। আর তা হলো চলতি ২০০৮-০৯ অর্থবছরের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না। আর এই না পারার কারণ হিসেবে তাঁরা বিশ্বমন্দাকে দায়ী করছেন। বলছেন, বিশ্ববাজারে প্রক্রিয়া করা চামড়ার দাম গত কয়েক মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এর প্রভাবও ইতিমধ্যে দেশের চামড়া রপ্তানির ওপর পড়েছে বলে তাঁদের দাবি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে অবশ্য এর কিছুটা সত্যতা মিলেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরের চামড়া রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ২৮ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ডলার। আর চলতি ২০০৮-০৯ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চামড়া রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ছয় কোটি ডলারের সামান্য ওপরে। এর মানে রপ্তানি কমেছে প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ।
তবে চামড়াজাত অন্যতম পণ্য পাদুকা রপ্তানির চিত্রটি যথেষ্ট ইতিবাচক। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পাদুকাসামগ্রী থেকে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৮৮ লাখ ডলার। ফলে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৯ শতাংশ। একইভাবে চামড়ার ব্যাগ ও পার্স রপ্তানি বাবদ চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আয় হয়েছে ৩৬ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ২৮ লাখ ডলার এবং প্রবৃদ্ধির প্রায় ৩০ শতাংশ।
তাই সার্বিকভাবে চামড়া খাত যে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, এমনটি বলা বোধহয় যুক্তিসংগত হবে না। একইভাবে সংগত হবে না চামড়া খাত নিয়ে বড় ধরনের আতঙ্ক ছড়ানো।
তবে চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় এবার খুচরা পর্যায়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছে। মূল কারণটা হলো আগে থেকেই দাম-দর নির্ধারণ করে দেওয়া। ঈদের আগে এক যৌথ সভায় বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) এবং বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ঢাকায় গরু ও খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট সর্বোচ্চ ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দর নির্ধারণ করে। মনে এই দামে পাইকার-আড়তদাররা হয়েছে।
অথচ গত বছর ঢাকায় গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৭০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট সর্বোচ্চ ৬০ টাকা দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। খাসি ও বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ছিল সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা। তবে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে প্রতি বর্গফুট চামড়া পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছিল।
এবার এত নি্ন পর্যায়ে দাম বেঁধে দেওয়া হলেও খুচরা পর্যায়ে যারা চামড়া কিনেছে তারা অনেক ক্ষেত্রেই এই মূল্যসীমার মধ্যে তা সংগ্রহ করতে পারেনি। আবার চামড়া সংগ্রহ করার পর এক-দুই দিন সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতেও কিছু খরচ হয়েছে। ফলে লাভের আশায় বিক্রি করতে গিয়ে তারা বিফল মনোরথ হয়েছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। অনেকে ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দরেই বিক্রি করেছে। অনেকে প্রথম দুই-তিন দিনে বিক্রি না করে বিপাকে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আলহাজ রেজাউল করিম আনসারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোরবানির আগেই এবার ট্যানারি মালিকেরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেন। ফলে ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দামের বেশি দিয়ে আড়তদারেরা চামড়া ক্রয়ে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে এবার ‘এক দিনের’ চামড়া ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম হাঁকিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করতে পারেনি। তা ছাড়া চামড়া কেনাবেচায় সন্ত্রাসী তৎপরতা ছিল না। ফলে বিভিন্ন স্থান থেকে আড়তে নির্বিঘ্নে চামড়া আসছে।’
কিন্তু খুচরা পর্যায়ে অস্বাভাবিক নিচু দর নির্ধারণের জন্য রেজাউল করিম আনসারী বিশ্বমন্দাকে দায়ী করেন। বলেন, ‘বিশ্বমন্দায় আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দর প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাও কমেছে। এতে ট্যানারি মালিকদের কারখানায় এখন প্রায় ৫০০ কোটি টাকার চামড়া অবিক্রীত পড়ে রয়েছে।’
রেজাউল করিম জানান, সারা বছর যে চামড়া সংগ্রহ করা হয় তার প্রায় ৯০ শতাংশ সংগৃহীত হয়ে থাকে কোরবানির সময়। কিন্তু এবার জাতীয় নির্বাচনের কারণে অন্যবারের চেয়ে কোরবানির পরিমাণ ৫ থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে।
কম দামের কারণে কোরবানির পশুর চামড়া প্রতিবেশী দেশে পাচার হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়ে রেজাউল করিম বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমার কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ট্যানারিগুলো উন্নতমানের প্রতি বর্গফুট চামড়া ১৮ টাকা ও একটু কম মানের চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২-১৩ টাকা দরে কিনেছে। তা ছাড়া পাকিস্তান ২০ টাকা দরে প্রতি বর্গফুট চামড়া কিনেছে। ফলে বাংলাদেশের চেয়ে দাম কম হওয়ায় পাচার হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তিনি পাল্টা দাবি করেন, তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে দাম বেশি হওয়ায় ভারতের অনেক ট্যানারি মালিক বাংলাদেশে চামড়া রপ্তানির ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।
রেজাউল করিম আনসারী আরও বলেন, চামড়া খাতের রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে দেশের ট্যানারি শিল্পগুলোকে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে। তা ছাড়া রপ্তানির ওপর নগদ সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে ন্যূনতম ২৫ শতাংশে নির্ধারণ করতে হবে।
উল্লেখ্য, চলতি ২০০৮-০৯ অর্থবছরের চামড়া রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৩০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২৮ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের চামড়া রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু ওই অর্থবছর চামড়া রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ২৯ কোটি ডলার। ফলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানি আয় কমেছিল সাড়ে ৩ শতাংশ।
সুনীতি বিশ্বাস
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৮
Leave a Reply