অর্থনীতির মন্দা ও বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন
সবার চোখ বড়দিন মৌসুমের বেচাকেনার ওপর
সবাই এখন তাকিয়ে আছে ক্রিস্টমাস বা বড়দিন মৌসুমের বিক্রির ওপর। অর্থনীতির মন্দা আসলে কতখানি, তা খানিকটা বোঝা যাবে এ সময়টায়। খুচরা ক্রেতারা যদি কেনাকাটা কমিয়ে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে মন্দা ভালোই জেঁকে বসছে। আজ তো জাতিসংঘ বলেই দিয়েছে, ১৯৩০ সালের পর বিশ্ব অর্থনীতি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
ক্রিস্টমাস সেল-এটা লিখে গুগল নিউজে সার্চ দিয়ে কয়েক শ নিউজ পাওয়া যাবে। সবাই এখন বুঝতে চাইছে, বিক্রি কমলে কতটা কমছে। সবারই আশঙ্কা, বিক্রি এবার কম হবে। যদিও শুরুতে সিএসবি নিউজ বলেছে, গত বছরের পর বিক্রি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। জরিপ থেকে দেখা গেছে, এবার এখন পর্যন্ত ১৭ কোটি ২০ লাখ মানুষ গত উইকেন্ডে স্টোরগুলোয় গেছে এবং একজন গড়ে কেনাকাটা করেছে ৩৭২ ডলার। গতবারের চেয়ে বেশি মানুষ স্টোরে গেছে-এক কোটি ৫০ লাখ মানুষ এবং গড়ে তারা বেশি খরচ করছে ৭•২ শতাংশ। বলে রাখি, এই হিসাব চূড়ান্ত নয়। এটি গত সপ্তাহের তথ্য। এর পরে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তা আশাব্যঞ্জক নয়। তবুও চূড়ান্ত তথ্য জানতে ডিসেম্বর পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য এ মৌসুমটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ক্রিস্টমাস মৌসুমে যদি বেচাকেনা কম হয়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানিতে। কেননা আগামী মৌসুমের জন্য তাহলে রপ্তানি অর্ডার কমে যাবে। সুতরাং বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য যতই নাকচ করি না কেন, ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষ যদি এই মৌসুমে কম কেনে, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে। এখন দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত খুচরা পর্যায়ে বিক্রির কী হাল হয়। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। তবে কতটুকু পড়ছে, তা জানা যাবে আগামী মার্চের মধ্যে।
বিশ্বব্যাংক অবশ্য এ নিয়ে মন্তব্য করে বেশ বিপাকেই পড়ে গেছে। কেননা তারা বলে দিয়েছে, বিশ্বব্যাপী যে মন্দা দেখা দিয়েছে তার কারণে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয় ও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এর প্রভাবে কমবে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি। তাদের প্রাক্কলন দুটি। এক হিসাবে চলতি ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আর পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে সেটি হবে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি হলো, চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ৬৪০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে আয় হয়েছে ৪৪০ কোটি ডলার। বাকি নয় মাসে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আয় বাড়াতে হবে ৯ শতাংশ হারে। কিন্তু মন্দার কারণে আগামী নয় মাসে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হলে রপ্তানি আয় হবে এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার এবং প্রবৃদ্ধি নেমে ৩ শতাংশ হলে আয় হবে এক হাজার ৫৭০ কোটি ডলার।
আর রেমিট্যান্স নিয়ে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এবার প্রবাসী-আয়ের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার কোটি ডলার এবং আট লাখ মানুষ কাজ নিয়ে বাইরে যাবে। তিন মাসে বিদেশে যেতে পেরেছে দুই লাখ ১৩ হাজার মানুষ। এখন মধ্যপ্রাচ্যে নির্মাণকাজে শ্লথগতি হলে যদি আর মাত্র চার লাখ মানুষ যেতে পারে, তাহলে আয় হবে ৯২০ কোটি ডলার এবং তিন লাখ মানুষ বাইরে গেলে আয় হবে ৮৯০ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের জন্য আমদানি-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা দুই হাজার ৩২০ কোটি ডলার। দুই মাসের আমদানি-ব্যয় ৩৮০ কোটি ডলার। সুতরাং বাকি ১০ মাসে আমদানি-ব্যয় ১০ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বাড়লে মোট আমদানি-ব্যয় ১০০ কোটি ডলার কমে হবে দুই হাজার ২২০ কোটি ডলার এবং ১৩ দশমিক ২ শতাংশ হারে বাড়লে ৫০ কোটি ডলার কমে দাঁড়াবে দুই হাজার ২৭০ কোটি ডলার।
বিশ্বব্যাংকের এই তথ্যের ভিত্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক নামের একটি প্রকাশনা। বিশ্বব্যাপী ২০০৮ সালে মোট বিশ্ব বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। মন্দার কারণে এই হার কমে হবে ২ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে উন্নত দেশগুলোর আমদানি ২০০৮ সালে ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। মন্দার কারণে কমে হবে ঋণাত্মক দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে ২০০৮ সালে রপ্তানি ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, মন্দার কারণে কমে হবে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৯ সালে কমে হবে ঋণাত্মক, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
এই হিসাবকে ভিত্তি করেই মূলত বিশ্বব্যাংক প্রবৃদ্ধি কমার প্রাক্কলন করেছে। গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য সাড়ে ৬ শতাংশ। আর কমে সেটা হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক অবশ্য বলেই দিয়েছে যে এগুলো সবই প্রাক্কলন। সঠিক অবস্থা বোঝা যাবে আগামী মার্চের মধ্যে। অনেক কিছুই নির্ভর করছে আগামী ক্রিস্টমাস মৌসুমের কেনাকাটার ওপর। সাধারণত ৪০ শতাংশ কেনাকাটা এই মৌসুমে হয়ে থাকে। ফলে কেনাকাটা কমে গেলে পরবর্তী মৌসুমের জন্য রপ্তানি আদেশ কমে যাবে।
বিশ্বব্যাংক এসব বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড• মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলনকে এককথায় নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে এমন মন্তব্য করা তাদের উচিত নয়। এমন পূর্বাভাস দেওয়ার আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করলে ভালো হতো।
বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন কতখানি সঠিক হবে, সেটি সময়েই বলে দেবে। তবে কিছু প্রভাব যে পড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ এখন অনেকটাই কম। কেননা আনুষ্ঠানিকভাবেই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। আর মন্দা যে সহজে দূর হচ্ছে না, সেটাই এখন সবাই বলছে। অন্তত প্রায় দুই বছর মন্দা চলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সুতরাং মন্দার প্রভাব কীভাবে ন্যূনতম রাখা যায়, সেটাই এখন মূল বিবেচনার বিষয়। আর যদি তা করা সম্ভব হয়, তাহলেই মিথ্যা প্রমাণিত হবে বিশ্বব্যাংক। আর তাতে বিশ্বব্যাংকের নাক গলানোও প্রতিহত করা যাবে।
সরকার অবশ্য একটা টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছে। অর্থসচিব ড• মোহাম্মদ তারেক এর প্রধান। এটি মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের একটি কমিটি। আমলানির্ভর এসব কমিটি শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনের সময় কী করতে পারবে, সে সন্দেহ থেকেই যায়। এসব কমিটি উদ্যোক্তা বা সাধারণ মানুষকে আস্থাশীল করতে পারবে বলে মনে করার তেমন কোনো কারণ নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগও (সিপিডি) একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এই টাস্কফোর্সে অবশ্য সব ধরনের মানুষই রয়েছে। তবে এই টাস্কফোর্স পারবে শুধু সুপারিশ করতে। অতীতে সরকার বেসরকারি খাতের সুপারিশ খুব বেশি গ্রহণ করেছে, তার নজির নেই। সুতরাং মন্দা সত্যিকারভাবেই প্রভাব ফেলতে শুরু করলে সরকার কী করবে, সেটি আসলে অজানা।
সবশেষে একটা জরিপের কথা বলি। পশ্চিমারা জরিপভক্ত। কত বিচিত্র বিষয়ে যে জরিপ করে তারা। গত ১ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব এইডস দিবস। অর্থনীতির মন্দা আর এইডস দিবস-এই দুইকে মিলিয়ে দিয়ে একটা জরিপ করেছে এইডস চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান টেরেন্স হিগিনস ট্রাস্ট। তারা যুক্তরাজ্যের দুই হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়েছে। জরিপে প্রশ্ন ছিল, এখন তাদের প্রিয় পাসটাইম বা সময় কাটানোর উপায় কী। বলে নিই, আগের জরিপগুলোয় এর উত্তর ছিল শপিং ও গসিপিং। অর্থাৎ কেনাকাটা ও আড্ডা মারা। এ দুটোই ব্যয়বহুল। জরিপে দেখা গেছে, স্কটিশদের মধ্যে ৪৩ শতাংশেরই সময় কাটানোর প্রিয় বিষয় হচ্ছে এখন শারীরিক মিলন করা। আর দক্ষিণ ইংল্যান্ডে এই হার ৩৫ শতাংশ। আর এর পরই হচ্ছে জাদুঘর বা মিউজিয়ামগুলোতে ঘোরা। কেননা এতে খরচ অনেক কম। অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচতে শারীরিক মিলনকেই এখন অনেকে বেছে নিয়েছে এবং এটা অনেক সস্তাও বটে। সংগঠনটি বলেছে, যুক্তরাজ্যে প্রোটেকশন বিক্রিও অনেক বেড়ে গেছে।
শওকত হোসেন মাসুম
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৭, ২০০৮
Leave a Reply