বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী চক্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতকে সচেতনভাবে ধ্বংস করেছে এবং তার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারকে তথাকথিত সাহায্যের প্রলোভন অথবা সাহায্য প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে। তা ছাড়া শর্তযুক্ত সাহায্যের অস্ত্রটি ব্যবহার করেছে। প্রত্যক্ষভাবে আদেশ-নির্দেশ দিয়েছে। সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে ভুল ও ক্ষতিকর এ নীতি আমাদের দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে তাদের অন্যতম সাধারণ অস্ত্রটি ছিল কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচির অস্ত্র। এই অস্ত্রটি প্রথম তারা প্রয়োগ করার সুযোগ পায় আশির দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকালে তৎকর্তৃক নয়া শিল্পনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে। জেনারেল এরশাদকে উন্নয়ন বাজেটের ১১২ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্য উপহার দিয়ে (যা কি না এ যাবৎকালের মধ্যে প্রদত্ত সর্বোচ্চ সাহায্যের রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত) লাভজনক-অলাভজনক নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। যদিও এই বিরাষ্ট্রীয়করণ বিনা বাধায় অগ্রসর হয়নি।
আমাদের শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের তীব্র সংগ্রাম ও রক্ত ত্যাগের পরও পরবর্তী সরকারগুলো অসহায়ের মতো এই একই নীতি অনুসরণ অব্যাহত রেখেছিল। যদিও তার গতি স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক শাসনামলে কিছুটা মন্থর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তথাকথিত সোনালি করমর্দনের নীতি গ্রহণ করে অসংখ্য শ্রমিক ছাঁটাই করা হয় এবং শ্রমিক নেতৃত্বকে নানাভাবে নিবীর্য করে তোলার চক্রান্ত অব্যাহত থাকে।
তবে একাধিক গবেষণা থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের সমস্যাগুলো কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় মালিকানার সমস্যা ছিল না। এগুলো ছিল পুঞ্জীভূত দেনার সমস্যা, মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতির সমস্যা, কোথাও কোথাও কিছুটা অতিরিক্ত জনবলের সমস্যা, আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতির সমস্যা, ভুল অর্থনৈতিক নীতিমালার সমস্যা, আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামার সমস্যা এবং সর্বোপরি দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমস্যা।
সুতরাং এসব সমস্যার প্রকৃত সমাধান না করে নামমাত্র মূল্যে বাংলাদেশের সংবিধানকে লঙ্ঘন করে জাতীয় শিল্প সম্পদকে গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়ার ফলে লাখ লাখ শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে চাকরি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ বিরাষ্ট্রীয়কৃত শিল্প হয় বন্ধ হয়ে গেছে নতুবা তাদের বিপরীতে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে একদল খেলাপি লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী। এবং দেশে সম্পদ ও বৈষম্য বহু গুণ বেড়ে গেছে।
এর ফলে পুরো জাতীয় অর্থনীতিতে আমাদের শিল্পের অবদান মোটেও আশানুরূপভাবে বাড়েনি। একমাত্র গতিশীল খাত হিসেবে যে কয়েকটি শিল্প এর মধ্যেও এ দেশে গড়ে উঠেছে, তা হচ্ছে সিমেন্ট শিল্প, রি-রোলিং শিল্প, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প এবং অসংখ্য নানা ধরনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের শিল্প। মরুভূমিতে ওয়েসিসের মতো এ সম্ভাবনাময় ছবিটি দেখে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিরাষ্ট্রীয়করণ নয় বরং ব্যক্তি খাতে জাতীয় পুঁজির নতুন বা ফ্রেশ বিনিয়োগের মাধ্যমেই আমাদের দেশে কিছুটা হলেও শিল্পায়ন ঘটেছে।
পক্ষান্তরে বিরাষ্ট্রীয়করণ মূলত ব্যবহৃত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের হরির লুটের কাজে। একটি উদাহরণই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। আদমজী জুট মিল তথা পাট খাতকে পুনর্বাসনের জন্য যে টাকার প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে বেশি টাকা দাতা দেশগুলোর পক্ষ থেকে ব্যয় করা হয়েছে এগুলো বন্ধ করা বা গুটিয়ে ফেলার জন্য।
বিশ্বব্যাংক শিল্প বিরাষ্ট্রীয়করণের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার সময় মিথ্যা তথ্য দিয়েছে এবং সত্য গোপন করেছে। প্রচলিত একটি যুক্তি হলো, সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি শিল্প খাতে যে বিপুল ভর্তুকি দিচ্ছে, তা ১৮ মাস না দিলে যে টাকার সাশ্রয় হবে তা দিয়ে নতুন যমুনা ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব।
এই আকর্ষণীয় যুক্তিটি ডাহা মিথ্যা। কারণ, ব্যাংকের হিসাব বইয়ে লিখিত পুঞ্জীভূত ঋণের যে সুদ তাকে লোকসান হিসেবে নির্ধারণ করে এবং পুরো শিল্প খাতের বিশেষ একটি শিল্প পাটের লোকসানের সঙ্গে তিনটি সেবা খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান তথা বিদ্যুৎ, ওয়াসা ও গ্যাস খাতের লোকসানের পরিমাণ যোগ করে, পুরো লোকসানের হিসাবটি করা হয়েছে। এটি মূলত কাগজপত্রে তৈরি একটি হিসাবের ব্যাপার মাত্র। এ জন্য রাষ্ট্রকে কখনোই সমপরিমাণ বাড়তি প্রকৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জন্য বাজেটে ভর্তুকি হিসেবে বরাদ্দ দিতে হয়নি। এ জন্যই পরে এসব কারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণের পরও দেখা গেল যে সরকারের হাতে যমুনা ব্রিজ তৈরির মতো অর্থের সাশ্রয় আদৌ ঘটছে না।
বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগীরা একদিকে যেমন অন্ধভাবে ব্যাংক ও শিল্প বিরাষ্ট্রীয়করণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তেমনি ঠিক একইভাবে তারা নির্বিচার অবাধ আমদানি নীতির সমর্থন করে গেছে। এর ফলে অনেক প্রতিযোগী আমদানি বিকল্প শিল্প শৈশবেই অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দেশের জাতীয় শিল্পায়ন ভিত্তি প্রসারিত হতে পারেনি। দেশ অধিক মাত্রায় পরনির্ভরশীল হয়েছে এবং স্থানীয় জাতীয় উদ্যোক্তা ও তাদের প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে সার্কভুক্ত সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শুল্ক হার কমানো হয়েছে শকিং স্পিডে। সেই সময়কার অর্থমন্ত্রী পরবর্তী সময়ে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, যদিও দাতারা বলেন, তারা আছে ড্রাইভিং সিটে। কিন্তু তা থাকলেও আসলে স্টিয়ারিং ধরে আছে দাতারা।
দুঃখ ও লজ্জার বিষয় যে সেই অর্থমন্ত্রীর আমলেই অত্যন্ত দ্রুতবেগে অবাধ আমদানির স্বার্থে যখন শুল্ক হার কমানো হলো, তখন অসংখ্য আমদানির বিকল্প শিল্প প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছিল। তখন তিনি তাতে কোনো কর্ণপাতও করেননি।
১৯৯৬ সালে পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের আরেকজন শিল্পমন্ত্রী হলেন একজন স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতা। যখন তিনি শিল্পমন্ত্রী হননি বা যখন তিনি বিরোধী দলে ছিলেন, তখন তিনিও কিন্তু বলেছিলেন, এভাবে দ্রুত শুল্ক হার হ্রাস করা ঠিক হয়নি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তিনিও পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসীন হয়ে শুল্ক হার হ্রাসের নীতিই অব্যাহত রেখেছিলেন। তাহলে কি বলতে হয়, জাতীয় স্বার্থবিরোধী অবাধ আমদানিনীতির জন্য বিশ্বব্যাংক গং-এর চাপ এতই প্রবল যে সামরিক আইনের পরিবর্তে গণতান্ত্রিকভাবে অধিষ্ঠিত সরকারগুলোও তাদের বিদগ্ধ মৃদু আপত্তি তুলেই তাদের চাপ হজম করে নিতে বাধ্য হয়। আমরা এ মামলার প্রধান আসামি হিসেবে বিদেশি সংস্থাগুলোকে আজ কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু তাদের চাপের কাছে যারা নতি স্বীকার করেছিল, তাদেরও আজ খুলে বলতে হবে, কেন তারা তা করেছিল।
[লেখকঃ অর্থনীতিবিদ। সংক্ষেপিত রচনাটি ১ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি গণ-ট্রাইব্যুনালে বাদী পক্ষের অভিযোগনামা হিসেবে উপস্থাপিত]
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৭, ২০০৮
Leave a Reply