সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলের সাধারণ প্রবণতা হলো, যার পাঠক বা দর্শক যত বেশি, তার বিজ্ঞাপনও বেশি। যার পাঠক বা দর্শক কম, তার বিজ্ঞাপনও কম। এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। বিজ্ঞাপনদাতারা সব সময় চায় তার বার্তাটি সর্বোচ্চসংখ্যক পাঠক বা দর্শকের কাছে পৌঁছাক। এ কারণে তারা বেশি টাকা খরচ করেও অধিক প্রচারসংখ্যার সংবাদপত্র বা দর্শকপ্রিয় টিভি চ্যানেলটিতে বিজ্ঞাপন দেয়।
কিন্তু ব্যতিক্রম তো হচ্ছেই। বিশ্ব অর্থনীতিতে গভীর সংকটের এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক সংবাদপত্র, রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। প্রচারসংখ্যা বাড়ছে সংবাদপত্রের, শ্রোতার সংখ্যা বাড়ছে রেডিওর, আর দর্শকের সংখ্যা বাড়ছে টিভি চ্যানেলের। ঋণের ভারে জর্জরিত ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী-সবাই ব্যাকুল অর্থনীতির খোঁজখবর জানতে, বর্তমানের খারাপ দিন কেটে সামনে সুদিনের সম্ভাবনা আছে কি না। কিন্তু পাঠক, শ্রোতা ও দর্শক বাড়লেও সেই হারে বিজ্ঞাপন বাড়ছে না এসব গণমাধ্যমের। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আরও কমছে।
সংকটের কারণে বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপনের বাজেটে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে আয় কমে যাচ্ছে জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলোর। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ভোগ কমে যাওয়ায় পণ্যের দামও কমছে, যা মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তেমন হলে বিজ্ঞাপন আরও কমার আশঙ্কা থাকছে।
এর মধ্যে আবার সংবাদপত্র, রেডিও ও টিভি চ্যানেলের জন্য নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ইন্টারনেট। উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা প্রায় নিখরচায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ঢুকে প্রয়োজনীয় খবর জেনে নিচ্ছে। অক্টোবরে ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক প্রখ্যাত সংবাদপত্র দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ইন্টারনেট পাঠকসংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় চার কোটি পাঁচ লাখে। ‘ইয়াহু ফিন্যান্সে’ গিয়ে বাণিজ্যের সর্বশেষ খবর জেনে নেওয়া ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণে।
ফ্রান্সের ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক জনপ্রিয় রেডিও বিএসএম। এই বছরে চ্যানেলটির খবর সম্প্রচার, টকশো, বিশ্লেষণ ভিন্নমাত্রা পায় এবং শ্রোতারাও তা দারুণভাবে নেয়। চ্যানেলটিতে শ্রোতাদের টেলিফোন, ই-মেইলের সংখ্যা অনেক বাড়ে। কিন্তু এই বছরে চ্যানেলটির বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমেছে অন্তত ২০ শতাংশ। এ অবস্থায় গণমাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ বলছেন, বিজ্ঞাপন নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় মনে হয় এসেছে।
বাণিজ্যবিষয়ক টিভি চ্যানেল সিএনবিসি জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এ বছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দিনের বেলার দর্শকসংখ্যা ২৬ শতাংশ বেড়েছে। আর সেপ্টেম্বরে তাদের চ্যানেলে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা থেকে ই-মেইল আসা বেড়েছে অন্তত ১৮০ শতাংশ। সিএনবিসির ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার প্রধান মাইক বাকলি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক চ্যানেলের জনপ্রিয়তা এসব এলাকায় কিছুটা কম। কিন্তু তার পরও ই-মেইল এত হারে বাড়া ব্যবসার খবরের প্রতি তাদের বিপুল আগ্রহ প্রমাণ করে।
অক্টোবরে লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর বৈশ্বিক প্রচারসংখ্যা বেড়েছে সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৫ শতাংশ। ফরাসি সংবাদপত্র লেস ইকোস-এর প্রচারসংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। বেড়েছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী লা ট্রিবিউন-এর প্রচারসংখ্যা।
গত বছর ডাউ জোন্স কিনে নেওয়ার পর নিউজ করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী রুপার্ট মারডক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ওয়েবসাইটে ঢুকতে সাবস্ক্রিপশন ফি তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু এ বছর আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তিনি তাঁর আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। সাবস্ক্রিপশন ফি প্রত্যাহারের অর্থ হবে ওয়েবসাইটটি চালানোর জন্য পুরোপুরি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল হওয়া।
বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক কিছু পত্রিকা তাদের বিপণন কৌশল পাল্টাচ্ছে। মারডকের পরামর্শে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এখন ব্যবসার খবরের বাইরে রাজনীতির খবরাখবরও গুরুত্ব দিয়ে ছাপছে, যাতে অন্যান্য খাতের বিজ্ঞাপনও আসে। একই কৌশল নিয়েছে লা ট্রিবিউনও। অক্টোবরের শেষে তারা পত্রিকার মেকআপে কিছু পরিবর্তন এনে নতুন চেহারা দিয়েছে। প্রথম পাতায় রাজনীতি ও অন্যান্য খবর প্রকাশ করছে। এতে এক মাসে তাদের প্রচারসংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এ পত্রিকাটি এত দিন ক্ষতির মধ্যে ছিল। এর মালিক আশা করছেন, বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকটের হাল যা-ই হোক, ২০১০ সালের মধ্যে তারা ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে (না-ক্ষতি, না-লাভ) পৌঁছাতে পারবে।
বিজ্ঞাপন কমে যাওয়ায় কোনো কোনো প্রকাশক সংবাদপত্রের দাম বাড়ানোর কথা বলছেন। এরই মধ্যে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যম সম্পর্কে অভিজ্ঞরা বলছেন, বিজ্ঞাপনের ওপর কম নির্ভর করে ভবিষ্যতে ঝুঁকিমুক্ত থাকা যাবে, এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।
কাজী আলিম-উজ-জামান
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৭, ২০০৮
Leave a Reply