বাস্তবায়ন হচ্ছে মৎস্য খাদ্য অর্ডিনেন্স ২০০৮
মৎস্য খাদ্যের ৪ ভাগের ৩ ভাগই ভেজাল
দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ময়মনসিংহ অঞ্চলে গত প্রায় এক দশকে মাছ চাষে যে বিপ্লব এসেছে, সে অপার সম্ভাবনা এখন ক্রমশ অনিশ্চয়তা আর ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে। এ অবস্থার জন্য নানাবিধ কারণ থাকলেও সম্প্রতি একটি বড় কারণ হচ্ছে মাছের খাদ্যে ভেজাল। মাছ চাষিরা জানিয়েছে, মাছের খাবার কিনে তারা এখন নিয়মিত প্রতারণার শিকার হচ্ছে। মাছের আকার কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। এদিকে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সম্প্রতি এক গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে দেখেছে, মাছের খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭৬ ভাগেরই উৎপাদিত পণ্য যথাযথ গুণমানসম্পন্ন নয়। ভেজালের কারণে মাছ চাষিরা কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাচ্ছে না। চালের কুঁড়োতে পাওয়া যাচ্ছে তুষ। খৈলে পাওয়া যাচ্ছে কাঠের গুঁড়ো, ছাই, পোড়ামাটির গুঁড়ো, পোড়া মবিল ইত্যাদি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এবং জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাছের খাদ্যের এমন ভেজাল প্রতিরোধে এ বছরই ‘মৎস্য ও পশুখাদ্য অর্ডিনেন্স ২০০৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি এখন বিধিমালা আকারে জারি করে বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এ আইনটি চালু হলে মাছের ভেজাল খাদ্য প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
বিএফআরআইর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকের ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জুলফিকার আলী বলেন, মাছ জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাদ্য যেমন শেওলা, পোকা, কীট ইত্যাদি খেয়েই বেঁচে থাকে এবং বড় হয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে মাছের চাষ করতে গেলে মাছের জন্য সুষম সম্পূরক খাদ্য অপরিহার্য। গত ১০ বছরের মধ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্যাপক হারে মাছ চাষ বৃদ্ধির ফলে মাছের খাদ্যের চাহিদাও বেড়ে যায়। মাছ চাষিদের চাহিদা মেটানোর জন্যই দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে মাছের খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান-কারখানা। কিন্তু সম্প্রতি খামারিদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক মৎস্যখাদ্যের গুণমান নিয়ে অভিযোগ আসছে।
ওই বিজ্ঞানীরা বলেন, বিএফআরআই পরিচালিত সম্প্রতি সমাপ্ত এক গবেষণার প্রয়োজনে দেশের ৬০টিরও অধিক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত মৎস্যখাদ্য তাঁরা সংগ্রহ করেন। এগুলোর অধিকাংশই পাঙাশ, কার্প ও তেলাপিয়ার। কিছু প্রতিষ্ঠান চিংড়ি, কৈ, মাগুর ও শিং মাছের খাদ্য বিপণন করে আসছে। মাছের প্রজাতিভিত্তিক বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হয় ছয় প্রকার খাদ্য। এগুলো মূলত পাউডার ও দানাদারজাতীয়। ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা করে দেখা যায়, মাছের খাদ্য উৎপাদনকারী শতকরা ৭৬ ভাগ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত খাদ্যেই ভেজাল। এগুলোতে মাছের প্রজাতিভিত্তিক পুষ্টি ও গুণগত মান যথাযথ মাত্রায় পাওয়া যায়নি। মাত্র ২৪ ভাগ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত খাদ্যের মান ভালো পাওয়া গেছে। তারা আরও বলেন, কিছু খাদ্য উৎপাদন কারখানায় ব্যবহৃত খাদ্য উপকরণ, যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, প্যাকিং উপাদান, জৈব নিরাপত্তার ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে উপযুক্ত মান বজায় থাকে না।
ওই দুই বিজ্ঞানী বলেন, দেশে বর্তমানে প্রাপ্ত মৎস্যখাদ্যের উপকরণের মূল্য অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায়, বাজারে দেশীয় এবং আমদানি করা মৎস্যখাদ্যের উপাদানের মধ্যে অধিকাংশই নি্নমানের এবং ভেজাল। চালের কুঁড়োতে পাওয়া যাচ্ছে তুষ। খৈলে পাওয়া যাচ্ছে কাঠের গুঁড়ো, ছাই, পোড়ামাটির গুঁড়ো, পোড়া মবিল ইত্যাদি। তারা বলেন, মাছের খাবারের জন্য বাজারের কিছু কিছু মাংস ও হাড়ের গুঁড়োয় ভেজাল দেখা যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে দুই ধরনের মাংস ও হাড়ের গুঁড়ো আমদানি হয় বলে তাঁরা জানান। এর মধ্যে একটি হলো সার হিসেবে, আরেকটি হলো মাছ-মুরগির খাদ্য হিসেবে। কিছু ক্ষেত্রে সার হিসেবে আনা মাংস ও হাড়ের গুঁড়ো মেশানো হচ্ছে মাছের খাদ্যে। আবার মাংস ও হাড়ের গুঁড়োর সঙ্গে ইউরিয়া মিশিয়ে প্রোটিনের মাত্রা বাড়ানোর প্রবণতাও আছে। ওই বিজ্ঞানীরা বলেন, এসব ভেজাল খাদ্য মাছের সার্বিক উৎপাদনে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দেশের পুরোনো এবং সফল মাছ চাষিদের মধ্যে একজন হলেন ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র ফিশ সিড কমপ্লেক্সের মালিক এ কে এম নুরুল হক। তিনি বলেন, মাছের খাবার তৈরির অনেক কোম্পানি আছে, যাদের প্রথম খাবারের চালানটি ভালো। কিন্তু এক-দুই মাস যাওয়ার পরই সেই খাবারে ভেজাল পাওয়া যায়। চাষিদের বিশ্বাস অর্জন করে পরে সেই চাষির সঙ্গেই কোম্পানিগুলো প্রতারণা করে। আবার চাষি যখন কোম্পানির ভেজাল খাবারের বিষয়টি বুঝতে পারে, ততক্ষণে তার ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। তিনি বলেন, মাছের খাবারে কুঁড়োর পরিবর্তে তুষ ও খৈলে ভুট্টা, নারিকেলের আর্চির গুঁড়ো মেশানো হয়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির মাছের খাবার ব্যবহার করার পর প্রথম দুই মাসে তার পুকুরের কৈ মাছ এক থেকে ৩৫ গ্রামে উন্নীত হয়। কিন্তু পরের এক মাসে যেখানে এ মাছের বাড়ার কথা ২৫ গ্রাম, তার বদলে হয় ১০-১২ গ্রাম। তিনি বলেন, মাছের খাবারে ভেজালের কারণেই বৃদ্ধির হার কমে যায়। দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো মাছের খাদ্য তৈরির যেসব কারখানা গড়ে উঠেছে তার মধ্যে হাতে গোনা ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব কটির বিরুদ্ধেই ভেজালের অভিযোগ আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার সোনালি মৎস্য খামারের মালিক মো. শামছুল ইসলাম তালুকদার বলেন, তিনি চাষ করেন কৈ, শিং, মাগুড় ও পাঙাশ মাছ। তাঁর নিজের চালকল থাকায় তিনি মাঝেমধ্যে নিজেই মাছের খাবার তৈরি করেন। এতে তিনি আর্থিকভাবে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ লাভবান হন। মাছের খাদ্যের ভেজাল সম্পর্কে তিনি বলেন, ভেজাল খাদ্য কিনে চাষিরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিজের একটি অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, মুক্তাগাছার একটি কারখানা থেকে কিছুদিন আগে ৪৬ লাখ টাকার খাদ্য কিনেছিলেন। পরে মাছের খাবারের বস্তা খুলে তিনি পেয়েছিলেন মাটি মেশানো খাদ্য। সেই কোম্পানির সঙ্গে তার ঝগড়াফ্যাসাদ শেষ পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পর্যন্ত গড়ায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের মাছের খাদ্য তৈরির কারখানাগুলো যেভাবে খুশি গড়ে উঠেছে, যেভাবে খুশি মাছের খাবার তৈরি করে বিক্রি করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের চালের কুঁড়ো ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। কুঁড়ো রপ্তানির কারণে দেশে মাছের খাদ্য তৈরির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।’
ভেজাল খাদ্য তৈরির বিষয়ে সরকারের ভূমিকা কী-এ প্রশ্নে বিএফআরআইর মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, অতীতে দেশে মাছের খাদ্য তৈরি, বাজারজাত করা ইত্যাদি বিষয়ে কোনো নীতিমালা ছিল না। সরকার এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে ইতিমধ্যেই ‘মৎস্য ও পশুখাদ্য অর্ডিনেন্স ২০০৮’ জারি করেছে। এটি বিধিমালা আকারে জারি হলে এ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে মাছের ভেজাল খাদ্য তৈরির বিষয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারবে।
ভেজাল খাদ্যের ব্যাপারে ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, মাছের খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের ভেজালের অভিযোগ তারা অনেক খামারির কাছ থেকেই পান। মাছ চাষে এটি একটি বড় ধরনের সমস্যা। তিনি বলেন, এর মধ্যে তারা গফরগাঁও থেকে অভিযোগ পেয়েছেন যে সেখানে মাছের খাবারে পাওয়া গেছে গোবরের গুঁড়ো; গৌরীপুর থেকে অভিযোগ পেয়েছেন, সেখানে পাওয়া গেছে বালি। তিনি আরও বলেন, মাছের খাবারে বিভিন্ন ধরনের ভেজালের কারণে অনেক চাষি কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন না পেয়ে কোনো কোনো মৌসুমে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে মাছ চাষিদের এমন অভিযোগের কারণে সরকারও এখন এসব অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত। এ জন্যই ‘মৎস্য ও পশুখাদ্য অধ্যাদেশ ২০০৮’ নামে একটি আইন এখন বিধিমালা আকারে প্রণয়নের অপেক্ষায়। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, এ আইনটি কার্যকর হলে মাছের খাবার উৎপাদনকারীদের তাঁরা আইনের আওতায় আনতে পারবেন। নজরদারিও চালাতে পারবেন এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. এম এ মজিদ বলেন, মৎস্য ও পশুখাদ্য অধ্যাদেশ আন্তরিকতার সঙ্গে মেনে চললে মাছের খাদ্যে ভেজালের এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি বলেন, মাছের খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেমন সতর্ক করতে হবে, তেমনি তাদের সচেতনতাও বাড়াতে হবে।
নিয়ামুল কবীর সজল, ময়মনসিংহ
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮
Subhankar Jolua, Kolkata
very good