চুয়াডাঙ্গার প্রত্যন্ত গ্রামের একজন সহজ-সরল বাসিন্দা আমিনা বেগম। তিনি একটি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের গৃহবধূ। বহু বছর আগে মাত্র ১২ বছর বয়সে এই পরিবারে এসেছিলেন নববধূর সাজে। কৃষক পরিবারে কি আর অবসর মেলে? এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে সংসারের অসংখ্য কাজের চাপে। বুঝতেই পারেননি-তাঁর ছয়টি ছেলেই কবে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। একসময় একে একে তারা পারি জমাল গ্রামের আঙিনা ছেড়ে শহরের উদ্দেশে। কেউ সেখানে পড়ালেখা করছে, কেউ-বা চাকরি। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছে বিভিন্ন শহরে। ছেলেদের পাঠানো টাকায় ভালোই আছেন তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজন। কাজের চাপ এখন অনেক কম। নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্ব তাই মাঝেমধ্যেই আমিনা বেগমের বুকে চেপে বসে। বাড়ির কাদালেপা ঝকঝকে উঠোনে আর দৌড়াদৌড়ি করে না তাঁর দুষ্টু ছেলেগুলো, সারা গায়ে কাদা মেখে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে বাবার বকা খায় না। চারটি ছেলের বিয়ে হয়েছে। বড় দুজনের ভারি মিষ্টি তিনটি ছেলেমেয়ে আছে। গ্রামের বাড়ির উঠানে বসে মায়ের মন কাঁদে ছেলেদের জন্য। বউ আর নাতি-নাতনিদের দেখার ইচ্ছা হয়। বছরজুড়ে তাই দুটো বিশেষ দিনের অপেক্ষা-কবে হবে ঈদের ছুটি? সারা বছরের ব্যস্ত নগরজীবনের সব কাজ ফেলে কবে ঘরে ফিরবে ছেলেরা?
ঈদের সময় ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি সবাই বাড়ি এলে কেমন লাগে? জবাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারলেন না গ্রামের সরল জননী। লাজুক মুখে হাসলেন, আস্তে করে বললেন, নাতি-নাতনিরা পিঠে খেতে ভালোবাসে, আর মুরগির ছোট ছানাগুলো নিয়ে খেলা করে। ছেলের বউরাও ভালো, বাড়ি এলে অনেক যত্ন করে। বললেন, ছেলেদের কথা খুব মনে পড়ে। বছরের মাঝখানে তাদের কেউ বাড়ি এলেও এত অল্প সময় থাকে যে মন ভরে না। তিনি বোঝেন যে ছেলেদেরও মন আকুল হয় বাবা-মাকে দেখার জন্য। কিন্তু তারা সময় পায় না। ঈদের সময় তাই ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি-নাতনির হইচই, কলরোলে মুখরিত হয় আমিনা বেগমের খালি বাড়ি। কোরবানি ঈদের গরু বাবাকে আগে থেকে কিনতে দেয় না ছেলেরা-কে ঈদের আগ পর্যন্ত দেখাশোনা করবে? তারা আসার পরই গরু কেনা হয়; কোরবানির সব কাজও তারাই করে।
চট্টগ্রাম শহরে হাজেরা খাতুনের দুই ছেলে ও নাতি-নাতনি নিয়ে জমজমাট সংসার। বাকি ছেলেমেয়েরা কেউ ঢাকায় থাকে, একজন থাকে আবুধাবিতে আর বাকিরা চট্টগ্রামেই-অন্য এলাকায়। যখন নাতি-নাতনিরা ছোট ছিল, সারাটা বাড়ি ভরে থাকত তাদের কলরোলে। হাজেরা খাতুন মন ভরে দেখতেন, উপভোগ করতেন। কোনো কোনো ঈদে ঢাকা থেকে স্বামী, সন্তানসহ আসত দুই মেয়ে মায়ের কাছে ঈদ করতে, সেই ঈদ হতো আরও বেশি আনন্দের, অনেক বেশি প্রাপ্তির। কিন্তু নাতি-নাতনিরা প্রায় সবাই এখন ঢাকায়। কেউ পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, একজন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিরত। বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ছেলে, ছেলের বউদেরও বয়স হয়েছে। সারা বছর তাঁদেরও মন ভারাক্রান্ত থাকে সন্তানদের জন্য। সারা বছরের সেই একাকিত্বের কষ্টকে ভুলিয়ে দেয় ঈদ। নাতি-নাতনিরা দল বেঁধে বাড়ি ফেরে। আর মেয়েরা এখনো মাঝেমধ্যে পুরো সংসার নিয়ে আসে বাপের বাড়ি ঈদ করতে। উপহারে ভরে যান হাজেরা খাতুন। গত বছর রোজার ঈদের কদিন পরেই এই বাসাতেই হয়ে গেল তার নাতির বিয়ের অনুষ্ঠান। সেবারের রোজার ঈদটি তাই ছিল অন্য রকম আনন্দের। তিন ছেলে আর ছয় মেয়ে তাদের পুরো পরিবার নিয়ে ঈদ করে গেল মায়ের সঙ্গে। হাজেরা খাতুন এখনো সেই আনন্দ, সেই উৎসবের কথা ভাবেন।
তিনি জানেন, প্রতি ঈদে এভাবে আপনজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়া সম্ভব নয়। তার পরও ঈদের সময় নাতি-নাতনিরা এখনো বাড়ি ফেরে। কোরবানি ঈদের গরু কোরবানি হয় এই বাসাতেই, তাই সকালবেলায় এসে হাজির হয় চট্টগ্রামের অন্য এলাকায় থাকা মেয়েরা, নাতি-নাতনিরা। তাঁকে সালাম করে শুরু করে ঈদের দিনটি উদ্যাপন। এটিই তাঁর সবচেয়ে বড় পাওয়া, সবচেয়ে বড় আনন্দ।
আয়েশা ইসলাম বরিশালে একটি এনজিওতে চাকরি করেন। তাঁর দুই মেয়ে ঢাকায় থাকে। একজন পড়ালেখা করছে, অন্যজন মাত্র চাকরিতে ঢুকল। স্বামী আরিফ ইসলাম ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা, তাঁর পোস্টিং খুলনায়। সারা বছর আয়েশা ইসলাম একাই বাড়িতে থাকেন। যদিও চাকরি করার সুবাদে অবসর সময় কমই মেলে, তার পরও বিষণ্নতা মাঝেমধ্যেই আঁকড়ে ধরতে চায় তাঁকে। বছরের কোনো ছুটিই মেলে না বাবা ও মেয়েদের। একেকজন সময় ও সুযোগ অনুযায়ী একেক সময় বাড়ি আসে, মাকে দেখে যায়। ঈদ তাই আয়েশা ইসলামের খুব কাঙ্ক্ষিত সময়। কেবল ঈদের ছুটিতেই স্বামী ও মেয়েদের একসঙ্গে কাছে পান তিনি। ঈদের সময় কী বিশেষ আয়োজন করেন তাদের জন্য? উত্তরে তিনি বলেন, তাঁর মেয়ে দুটো খেতে চায় না, তাই বিশেষ খাবার তেমন রান্না করেন না; বরং একা একা মার্কেট ঘুরে মেয়েদের জন্য ঈদ-উপহার কেনেন, মেয়েরা তাতেই খুব খুশি হয়। আর যখন মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে, তখন কীভাবে কাটবে ঈদের দিনগুলো? জবাবে আবেগ চেপে রাখতে জানা চাকরিজীবী জননী মাথা নেড়ে বললেন, ‘মেনে তো নিতেই হবে, কী আর করার। মেয়েদের সংসার হলে শ্বশুরবাড়িতেই তারা ঈদ করবে, জীবনের এটাই তো নিয়ম।’
সত্যি, জীবনের নিয়ম হয়তো এটাই যে একসময় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বড় হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে নিজেদের জীবন নিয়ে। আর মায়ের সময় কাটবে সন্তানের পথ চেয়ে, তাদের বাড়ি ফেরার আশায়। এভাবে সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকা বাংলাদেশের অসংখ্য জননী তাই অপেক্ষা করেন ঈদের জন্য। কবে ঈদ আসবে? কবে ঘরে ফিরবে তাঁদের আদরের ধনেরা?
উপমা মাহবুব
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০২, ২০০৮
Leave a Reply