ওদের সমাদর ঘুটঘুটে অন্ধকারে হঠাৎ সার্চলাইটের আলো এসে পড়ার মতোই। চোখে রঙের খেলায় ঝিঁঝি সরে যাওয়ার আগেই ধপ করে নিভে যায় এর ঝলকানি। তারপর যেই সেই। ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনায় বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাটাকে যখন সবার ওপরে ধরে রেখেছিল, তখন যেন সবাই ছিল লিথির সঙ্গে। ওই সাহস আর উৎসাহেই হয়তো সম্ভব হয়েছিল সেবারের স্পেশাল অলিম্পিক থেকে দু-দুটি স্বর্ণপদক নিয়ে আসা। লিথি একা নয়, তাঁর সঙ্গে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরেছিল তাঁদের পুরো দল। বেশ কয়জন মেয়েও ছিল সেই দলে। তখন সত্যি আমরা সবাই ছিলাম ওদের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর বাসায় মেহমান হয়ে মধ্যাহ্নভোজ কিংবা ঘটা করে জাতীয় সংবর্ধনা-সবই হয়েছিল। তারপর? তারপর অনেকেই ভুলে গেছেন তাঁদের। তবে ওদের মনে করি আমরা। আজও করব, আজ যে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। ওরা এখন যেন শুধু বিশেষ দিনের বিশেষ অতিথি।
সানজিদা রহমান লিথি। প্রতিবন্ধী বললে ভীষণ খেপে যায় সে। লিথির ভাষায়, শিক্ষালয়ের অন্য সহপাঠী যারা কিছুই করতে পারে না, তারা প্রতিবন্ধী। ও প্রতিবন্ধী হবে কেন, ও তো সব পারে। খুব সুন্দর গান গায় লিথি। দেশে-বিদেশে প্রতিবন্ধীদের নানা অনুষ্ঠানে গান করেছে সে। স্কুলে হাতের কাজও শিখেছে। ইদানীং টেলিভিশনে ছোটদের গানের প্রতিযোগিতার একটি অনুষ্ঠান দেখে বায়না ধরে ওই অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সেও গাইবে। ছোট ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে গেলেও লিথি এখনো ছোট। বর্ণমালার সেই একই বিন্যাস সে প্রতিদিন নতুন করে শেখে বিশেষ স্কুলে-প্রায় দেড় দশক ধরে। বুদ্ধিমত্তায় ওরা বাড়ে না, ওদের সঙ্গে যেন বেখাপ্পাভাবে বেড়ে ওঠে চারপাশটা। সেই ফারাকে খাপ খাওয়ানোর জন্য ওদের পরিবার আর আপনজনের লড়াইটা যেন আজীবনের। এর মাঝেই ওদের ছোট-বড় অর্জনগুলোতেই আশার আলো হাতড়ে বেড়ায় তাদের পরিবার।
আর দশটি শিশুর মতো লিথির জন্মের পরও তাঁর মা দিলওয়ার জাহানের চারপাশটা ছিল খুব সাধারণ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা। কিন্তু বছর দুয়েক পর থেকে তিনি যখন বুঝতে পারলেন, তাঁর সন্তানটি আসলে স্বাভাবিক নয়, তখন থেকেই বদলে যেতে লাগল তাঁর চারপাশটা। লিথির বাবাকে হারানোর পর থেকে তাঁকে লড়তে হয়েছে অনেকটা একাই। তবে পারিবারিক সমর্থন ছিল ভীষণ রকমের। এত কিছুর পরও এক মুহূর্তের জন্য তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তানটিকে বোঝা মনে করেননি তিনি। তবে তাঁর কিছু আক্ষেপ আছে। তিনি বলেন, ‘একটি প্রতিবন্ধী সন্তানকে ঘিরে আলাদা একটা চিন্তার জায়গা থাকে তার পরিবারের। আর সে যদি মেয়ে হয়, তাহলে তা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এর মধ্যে একটু সম্ভাবনা আর আলো দেখলে সেটা আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয় খুব। কষ্ট লাগে এই আশার আলোটা যখন শুধুই ক্ষণিকের ঝলকানি হয়। ওরা ভালো কিছু করছে দেখলে আমরা মনে জোর পাই। সবাই যখন প্রশংসা করে তখন মনে হয়, আমরা একা না। কিন্তু কষ্ট লাগে বিশেষ দিনগুলোর পর ওদের যখন ভুলে যায় সবাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতা, কোনো অনুষ্ঠানে ভালো গান করা কিংবা বিশেষ দিনগুলোতে ওদের পাশে এসে দাঁড়ায় অনেকে। কিন্তু পরে আর কেউ থাকে না। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য যদি কিছু বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেত, তাহলে ওরা যেমন একটু একটু করে এগোতে পারত, তেমনি ওদের পরিবারের অন্য সবার কাছেও মনে হতো না যে ওরা একা। সেই সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের প্রতি আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গিটাও আরেকটু আন্তরিক হওয়া দরকার।’
লিথি একদিক দিয়ে বেশ ভাগ্যবতী। পরিবারের মধ্যমণি সে। আত্মীয়স্বজন সবার কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায় সে। এটা সব প্রতিবন্ধী শিশুর ভাগ্যে জোটে না। অনেক পরিবারে, বিশেষ করে মেয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের একটু আড়ালে রাখা হয়। এতে করে ওদের চারপাশটা আরও ছোট হয়ে আসে। দিলওয়ার জাহান বললেন, পিছিয়ে থাকা সন্তানটিকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর সেই সঙ্গে সবার আরেকটু সহযোগিতা পেলে হয়তো আশার আলো আসবে প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিবারেও।
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এই দিনে নারীমঞ্চের বিশেষএ আয়োজন।
জাবেদ সুলতান পিয়াস
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০২, ২০০৮
Leave a Reply