লিফ্ট নেই। তাই স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। কেউ বা একটি হাতেই দক্ষভাবে ব্যাগ, ফাইল, কলমটি আগলে ঘরের ভেতরে ঢুকছেন।
পরিবেশটি তার জন্য আজ একটু অচেনা। তিনি দৃষ্টিহীন, এ জন্য বসার জায়গাটি পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। প্রতিটি চেহারায় ফুটে আছে আত্মবিশ্বাস। সবাই মিলিত হয়েছেন প্রতিবন্ধি নারীদের অধিকার সম্পর্কিত জাতীয় সংলাপে। না, তাঁরা কেউ আজ এখানে তাঁদের হারানোর ব্যথা জানাতে আসেননি; এসেছেন নিজেদের অধিকার, যোগ্যতার কথা তুলে ধরতে। ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি ‘ঢাকা প্রেসক্লাবে’ এটি আয়োজন করে।
তুলে ধরা হয় বিভিন্ন সমস্যার কথা, তাদের স্বাভাবিক জীবনের বাধার ধাপগুলো কেন তৈরি হচ্ছে। বেশির ভাগ অভিভাবকের কারণে প্রতিবন্ধী শিশুরা ভর্তি হতে পারছে না সাধারণ বিদ্যালয়ে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাচ্ছে না চাকরি, পাচ্ছে না নেতৃত্বের কোনো স্থান। অংশ নিতে পারছে না নির্বাচনে। উপস্থিত সবার আক্ষেপ, শিক্ষিত সমাজ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সৃষ্টি করছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা।
দুর্ঘটনায় একটি পা হারিয়েছেন জুলেখা খাতুন জুলি। কিন্তু থেমে থাকতে দেননি জীবনকে। মাস্টার্স শেষ করে একটি হাইস্কুলের শিক্ষক। তৈরি হচ্ছেন বিসিএস পরীক্ষার শেষ ধাপটি উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। তিনি জানেন, তিনি সব করতে পারবেন। ‘আমি যে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতাম, তিনি দোতলায় উঠতে পারতেন না। আমি তো দোতলায় উঠতে পারি। তার জন্য আমাকে থাকতে হয়েছিল হাসপাতালের এক তলায়। তাহলে এখানে প্রতিবন্ধী কে?’ প্রশ্নটি জলির। কিন্তু সবারই ছিল এই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
সংলাপে সেদিন উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন হাইকমিশন প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব রেজাউল করিম। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডভোকেট কহিনুর বেগম বলেন, ‘রাষ্ট্র থেকে অনেক রকম আইন করা হয় প্রতিবন্ধীদের জন্য। সমস্যা হয় বাস্তবায়নে। পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র-সবখানেই বাধা সৃষ্টি করে আমাদের আচরণ। যেটা বদলানো দরকার। সংলাপে বেরিয়ে এল সমাধান। প্রধান সমস্যা হলো মানসিক প্রতিবন্ধিতা। শিক্ষিত সমাজই এটা ধারণ করে আছে। পরিবার থেকে আসা উচিত পূর্ণ সহযোগিতা।
তাদের লুকিয়ে রাখার বদলে দিতে হবে সাহস, বাড়াতে হবে আত্মবিশ্বাস। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বাড়াতে হবে অংশগ্রহণের সংখ্যা। যোগ্যতা অনুযায়ী নিশ্চিত করতে হবে চাকরি, ব্যবস্থা করা দরকার কোটার। নির্বাচন ও নারী নেতৃত্বের পথ সৃষ্টি করা দরকার। সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং সব ক্ষেত্রে সহযোগিতা।
রয়া মুনতাসীর
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০২, ২০০৮
Leave a Reply