কোরবানি পশুর চামড়া সঠিকভাবে এবং মাপমতো যদি ছাড়ানো না হয়, তবে পুরো চামড়া ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। যদিও বা চলে, তবে খুব একটা দাম উঠবে না। তাই সঠিক নিয়মে চামড়া ছাড়ানোর কলাকৌশল এবং তা সংরক্ষণের নিয়মকানুন জেনে নিই।
চামড়া ছাড়ানোর কৌশলঃ ‘চামড়া ছাড়ানোর আগে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তা না হলে চামড়ায় ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে।’ কথাগুলো বলছিলেন কারওয়ান বাজার কাঁচাবাজারের কসাই মো· মিন্টু। গরু বা ছাগল-যে পশুর চামড়াই ছাড়াতে চান না কেন, অবশ্যই নাইলনের মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত কোনো খুঁটির সঙ্গে পশুটি ঝুলিয়ে দিতে হবে। এরপর জবাই করা কাটা দাগ থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে ধীরে ধীরে হালকা করে কেটে নিচে নামতে হবে। প্রথমে পশুর ওপরের দিকে দুটি পা থেকে শুরু করে নিচের পা দুটি একইভাবে ছাড়াতে হবে। অনেকেই চামড়া ছুরি দিয়ে কেটে নেওয়ার পর টান দিয়ে নিচের দিকে নামাতে থাকে। কিন্তু এতে একটু ভুলেই ছিঁড়ে যেতে পারে চামড়া। ছাগলের চামড়া আলাদা করার সময় পায়ের নিচের অংশ কেটে ফুঁ দিয়ে বা পাম্প করে ফুলিয়ে নেবেন, তাহলে চামড়া আলাদা করার সময় আপনাকে বেশি বেগ পেতে হবে না; চামড়া ভালো থাকবে। গরুর চামড়া আলাদা করার সময় পানি ও ধারালো ছুরি ব্যবহার করবেন। ভোঁতা ছুরি দিয়ে ছাড়ানোর সময় চামড়া ছিঁড়ে যেতে পারে। চামড়া ছাড়ানোর পর অনেকেই তা যেনতেনভাবে মাটিতে ফেলে রাখে। একটু সময় করে ভাঁজ করে রাখুন। পানি লাগানোর প্রয়োজন নেই। ছাগল বা গরুর মাথার চামড়াও মূল্যবান। এটি আলাদা করার সময় অবহেলা করা উচিত নয়।
চামড়ার ধরনঃ গরু-মহিষের চামড়া সাধারণত তিন ধরনের হয়। নাগরা সোল (লম্বা চামড়া), চীনা চামড়া ও কুরুম চামড়া। ছাগল বা ভেড়ার চামড়াও তিন রকমের-স্টার, হেক্তি ও মেল চামড়া। অনেক সময় দেখা যায়, কোরবানির পশুটি রোগমুক্ত হলেও চামড়াটি মোটেই রোগমুক্ত নয়। এটি নানা রকম রোগে আক্রান্ত। রোগগ্রস্ত চামড়ার দাম খুবই কম, না কেনাই ভালো।
চাড়মা ছাড়ানোর পরঃ ছাড়ানো চামড়ায় প্রথমেই দেখতে হবে কোনো প্রকার মাংস বা চর্বি লাগানো আছে কি না। যদি থাকে তবে খুব আস্তে ধারালো ছুরি দিয়ে সেগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। এরপর চামড়াটি পরিষ্কার পানির দিয়ে খুব ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। তারপর চামড়া হালাকা রোদে পানি ঝরিয়ে নেওয়ার জন্য শুকাতে হবে। পানি ঝরে গেলে তা গাঁট বেঁধে নির্দিষ্ট স্থানে বা পাইকারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, এতে ঝামেলা ও ঝুঁকি কম হবে। চামড়া ছিলে ফেলার সাত থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে তা বিক্রি করা না গেলে সংরক্ষণ করতে হবে। চামড়া ছাড়ানোর পর দুই থেকে তিন ঘণ্টার (গরমকালে) এবং চার থেকে ছয় ঘণ্টার (শীতকালে) মধ্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুবা কাঁচা চামড়ায় পচন ধরে যাবে। এই পচন থেকে চামড়াকে রক্ষা করতে না পারলে ভালো মানের চামড়া পাওয়া সম্ভব নয়। এতে দামও অনেক কমে যাবে।
চামড়া সংরক্ষণঃ চামড়া সংরক্ষণের নানা রকম পদ্ধতির মধ্যে আছে লবণ দিয়ে, রোদে শুকানো এবং হিমাগারে সংরক্ষণ। তবে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি লবণ দিয়ে রোদে শুকানো।
লবণ পদ্ধতিঃ চামড়ার ধরন বুঝে চামড়ার মাংসল স্থানে লবণ মাখিয়ে এর গুণাগুণ ঠিক রাখা সম্ভব। গরু বা মহিষের চামড়ার ক্ষেত্রে নাগরা সোল চামড়ায় তিন থেকে পাঁচ কেজি, ঢিলা চামড়ায় দুই থেকে চার কেজি এবং কুরুম চামড়ায় দেড় থেকে তিন কেজি লবণ লাগাতে হবে। ছাগল বা ভেড়ার চামড়ার ক্ষেত্রে স্টার চামড়ায় আধা কেজি, হেভি ও মেল চামড়ায় ২৫০ গ্রাম লবণ দিতে হবে। এভাবে লবণ মাখিয়ে চামড়াগুলো ভাঁজ করে একটির ওপর আরেকটি স্তূপাকারে রাখা হয়। লবণের পর্যাপ্ততা না থাকলে লবণ ও পানির মিশ্রণের সাহায্যেও চামড়াকে কিছুদিনের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
রোদে শুকানোঃ চামড়া অনেকভাবে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়, যেমন-চামড়া কোনো খোলা মাঠে বা খোলা মেঝেতে বিছিয়ে রেখে; কোনো খোলা স্থানে তারের সাহায্যে ঝুলিয়ে এবং কোনো খোলা মাঠ বা খোলা স্থানে বাঁশের তৈরি ফ্রেমের সঙ্গে চামড়া বেঁধে রেখে। তবে রোদে শুকানো চামড়ার কিছু কিছু অসুবিধাও রয়েছে। রোদে শুকালে চামড়ার গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণ সবচেয়ে সহজ ও সুবিধাজনক উপায়।
হিমাগারে সংরক্ষণঃ সারা দেশে চামড়া সংরক্ষণের জন্য বড় ট্যানারিগুলোয় একটা করে হিমাগার থাকে, যেখানে চামড়া সংরক্ষণ করা হয়। চামড়া সংরক্ষণের প্রধান কারণ হলো যেন পরবর্তী সময়ে সেগুলোকে বিক্রির মাধ্যমে বেশি টাকা আয় করা যায়। ব্যাকটেরিয়া অথবা অন্য কোনো কীটপতঙ্গের সংক্রমণের হাত থেকে চামড়া রক্ষা করার জন্য কিছু ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক রাসায়নিক পদার্থ লবণের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
তাই চামড়ার ধরন ও গুণাগুণ বুঝে চামড়া ভালো রাখার জন্য কোরবানির পর একটু যত্ন নিয়ে ভালো মানের পাকা চামড়া তৈরি করা যায়।
নাজমুল হাসান
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০২, ২০০৮
Leave a Reply